ই-পেপার | রবিবার , ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অবিক্রিত হাজার হাজার টন লবণ, আমদানির খবরে দুশ্চিন্তায় চাষিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক , কক্সবাজার :

৭০-৭৫ হাজার টাকায় জমি বর্গা নিয়ে লবণ চাষ করতে মাঠে নামেন চাষিরা। জীবিকার তাগিদে রোদে পুড়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লবণ উৎপাদন করেন তারা। মাঠের বিভিন্ন গর্তে গত বছরের উৎপাদিত লবণ রয়ে গেছে হাজার হাজার টন। এমন পরিস্থিতিতে লবণ আমদানির খবরে চিন্তায় লবণচাষিদের কপালে ভাঁজ পড়েছে।

 

কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও বাঁশখালী ছনুয়ার কিছু কিছু এলাকায় নতুন লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। অন্যান্য এলাকার জমিতে লবণ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন চাষিরা। শিগগিরই সেসব জমিতেও লবণ উৎপাদন শুরু হবে। গত মৌসুমের হাজার হাজার টন পুরনো লবণ এখনো গর্তে পড়ে আছে। এরই মধ্যে লবণ আমদানির খবর শুনে অনেকটা মুষড়ে পড়েছেন চাষিরা। সরেজমিন দেখা যায়, কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর ধরুং ইউনিয়নের মসজিদপাড়ায় লবণ মাঠ তৈরির কাজ করছেন চার শ্রমিক। তারা লবণ চাষি ছলিম উল্লাহর শ্রমিক।

ছলিম উল্লাহ বলেন, চলতি মৌসুমে পাঁচ একর জমিতে লবণ চাষ করেছি। আবহাওয়া ভালো থাকলে আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে মাঠ থেকে লবণ তুলতে পারব। ছলিম উল্লাহ আরও বলেন, লবণ মাঠে গর্তের ভেতর এখনো ৮ হাজার মণ লবণ অবিক্রীত আছে।

এদিকে রাজাখালীর আরবশাহ বাজারের পশ্চিমে ট্রলারে লবণ ভরছেন চাষি আইয়ুব আলীর শ্রমিকরা। তিনি বলেন, ট্রলারে করে এই লবণ চট্টগ্রামের পটিয়া ও নারায়ণগঞ্জের লবণ মিলে যাবে। গর্তে গত মৌসুমের পুরনো অনেক লবণ মজুত রয়েছে।

রাজাখালীর মিয়াপাড়া ও মাতবরপাড়ায় পুরোদমে শুরু হয়েছে লবণ উৎপাদন। চাষিরা লবণ মাঠের পলিথিন থেকে লবণ তুলছেন। লবণ তোলার সময় কথা হয় শ্রমিক আবদুর ছবুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাঠের বিভিন্ন গর্তে গত বছরের উৎপাদিত লবণ রয়ে গেছে হাজার হাজার টন। শুনতে পাচ্ছি সরকার আবার লবণ আমদানি করবে। এমনটি হলে লবণচাষিরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়বেন।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক), কক্সবাজার কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর ও টেকনাফ উপজেলা এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার আংশিক এলাকায় আগাম লবণ চাষ শুরু করেছেন চাষিরা। পুরোদমে লবণ উৎপাদন শুরু হলে চলতি মৌসুমে কী পরিমাণ লবণ উৎপাদন হবে তার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে।

লবণচাষিরা বলেন, গত মৌসুমে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি না হওয়ায় চাষিরা ভালো দাম পেয়েছেন। এ কারণে চাষিরা আবারও খুশি মনে লবণ চাষ করতে মাঠে নেমেছেন। এর আগের চার মৌসুম চাষিরা লোকসান গুনেছেন। অনেকে ন্যায্য দাম না পেয়ে লবণ চাষ বাদ দিয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের কাছে চাহিদা বেশি উৎপাদন কম— এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে অগ্রিম লবণ আমদানি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন মিলমালিকদের একটি চক্র। এ অভিযোগ লবণচাষিদের। তারা দেশে লবণের ঘাটতি দেখিয়ে লবণ আমদানির জন্য সব রকমের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। চাষিদের দাবি, দেশে যে পরিমাণ লবণ উৎপাদন হচ্ছে, তাতে কোনো ঘাটতিই থাকবে না।

বাংলাদেশ লবণচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় অন্তত এক মাস আগে মাঠে নেমেছেন লবণচাষিরা। কুতুবদিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও বাঁশখালীর ছনুয়া এলাকায় লবণ উৎপাদনও শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকার বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করছে, এ খবর পেয়ে উদ্বেগ ও আতঙ্ক কাজ করছে চাষিদের মাঝে। ইতোমধ্যে ১ লাখ টন লবণ বিদেশ থেকে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আরও লবণ আমদানি করা হলে চাষিরা আর মাঠে নামবেন না।

তিনি আরও বলেন, লবণ আমদানির কথা ছড়িয়ে দিয়ে কিছু মিলমালিক চাচ্ছেন চাষিরা লবণ উৎপাদনে মাঠে না নামুক। তখন দেশটি লবণ আমদানিনির্ভর হয়ে গেলে মিলমালিকরা লুটপাট করে খেতে পারবেন। গত মৌসুমে ভালো দাম পাওয়ায় এবার আরও বেশি জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে।

বিসিক কক্সবাজার কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভুঁইয়া বলেন, চলতি মৌসুমে কী পরিমাণ লবণ উৎপাদন হবে তার এখনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি।

জাফর ইকবাল বলেন, ইতোমধ্যে কুতুবদিয়া ও পেকুয়ায় মাঠ থেকে মৌসুমের প্রথম দফার লবণ তুলেছেন চাষিরা। আশা করা হচ্ছে, ডিসেম্বরে লবণ উৎপাদন পুরোদমে শুরু হবে। দেশে লবণের কোনো ঘাটতি থাকবে না। সরকার ইতোমধ্যে ১ লাখ টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এটাতে লবণচাষিদের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না।

বাংলাদেশ লবণচাষি সমিতির সভাপতি শহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, দেশের লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। এতে দেশের অর্থনীতির চরম ক্ষতি হবে। দেশীয় লবণশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য হলেও সরকারকে লবণ আমদানির মতো সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা উচিত।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প (বিসিক) কুতুবদিয়া শাখার পরিদর্শক জাকের হোছাইন বলেন, গত মৌসুমে উৎপাদিত লবণের মজুত শেষ হওয়ার আগেই চলতি মৌসুমে উৎপাদিত লবণ বাজারে যাবে এবং তা দিয়ে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।