ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গবন্ধু টানেল: পিডি হারুন পটিয়া রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র

আবদুল হাকিম রানা, পটিয়া :

 

আজ আলো ছড়াবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। ওয়ান সিটি টু টাউনের প্রত্যয়ে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এই টানেল। আজ শনিবার (২৮ অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে এসে টানেলটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন এবং আগামীকাল রবিবার এটি খুলে দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে কর্তৃপক্ষ।

 

আর এর টোল আদায় করবে চায়না কমিউনিকেশন। এ টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার চার হাজার ৪৬১ কোটি টাকা ও বাকি পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা চীনা সরকার প্রদান করে। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে।

 

দেশের শ্রেষ্ঠ মেগা প্রকল্পের মধ্যে খুবই আলোচিত এই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পটিয়ার সন্তান প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ। তিনি পটিয়া পৌর সদরের আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি ১৯৭১ সালে এ স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি প্রথমে চট্টগ্রাম ওয়াসা এবং পরবর্তীতে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন।

 

এই অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রকৌশলী হিসেবে অবসর গ্রহণের পর তিনি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব পেয়ে ইতিহাসের অংশ হয়েছেন। তিনি বলেন, ব্যতিক্রমী ও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য প্রথম এই নির্মাণযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত থাকা সত্যিই গৌরবের। আমি খুবই উপভোগ করেছি। কারণ, এটি বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং সমাজের জন্য নতুন কাজ ছিল। প্রথমে আমি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিকট শোকরিয়া জ্ঞাপন করছি। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যে , তিনি আমাকে এখানে কাজ করার সুযোগ করে দিয়ে গৌরবের অংশীদার করেছেন।

 

তিনি বলেন, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমি টানেলের সঙ্গে যুক্ত। প্রথমে উপ-প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ছিলাম। ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। অর্থাৎ প্রকল্পের শারীরিক কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে আমি পরিচালক হিসেবে আছি। ২০১৫ সালে আমি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসর গ্রহণ করি। চাকরিকালীন আমি বিভিন্ন ব্রিজ-কালভার্ট, বিভিন্ন রাস্তা, বরিশালের দপদপিয়া ব্রিজ এবং কর্ণফুলীর শাহ আমানত সেতুর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।

 

তিনি টানেল এর কাজ প্রসঙ্গে বলেন, টানেল খনন যেহেতু বাংলাদেশে প্রথম, আমরা এই প্রযুক্তি দেখে দেখে শিখেছি। সুতরাং এখানে কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। টানেল বোরিং মেশিনের ওজন ছিল দুই হাজার ২০০ টন। এটি দিয়ে টিউব খননের শুরুতে অর্থাৎ যখন পাঁচ শতাংশ কাজ শেষ হয়, তখন এর একটু ঊর্ধ্বগতি প্রবণতা দেখা দেয়। একইসঙ্গে টিউবের রিংগুলো প্রতিস্থাপনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। ওই সময় অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আমরা আল্লাহর রহমতে সেটি ওভারকাম করতে সক্ষম হই।

 

 

এরপর ওই টিউবের কাজ যখন অর্ধেক শেষ হয় অর্থাৎ নদীর গভীরতম অংশে পৌঁছায় তখন টানেলের মেইন বোরিং মেশিনের শিল্ডে একটু ডিফর্মেশন (বিকলতা) পাই। এটি যখন একটু চেঞ্জ হয়ে যায় তখন আমাদের কাজকর্ম একটু ব্যাহত হয়। এরপর আমাদের এবং চীনের বিশেষজ্ঞ টিম সমস্যার সমাধান করে।

 

 

এছাড়া তেমন কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, এ টানেল হওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে। বিশেষ করে মাতারবাড়িতে নির্মিত হওয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে। বন্দরের কার্যক্ষমতা অক্ষুণ্ন রেখে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে চট্টগ্রাম গড়ে উঠবে। চট্টগ্রামের দক্ষিণে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে এবং সেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

 

এ ছাড়া, কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে। এছাড়া ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা আনোয়ারা, পটিয়া, কর্ণফূলী বাঁশখালী, চন্দনাইশ সাতকানিয়া, লোহাগাড়া উপজেলা এবং বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার লোকজন বিমানবন্দরে আসার ক্ষেত্রে সুবিধা পাবেন। আগে তাদের অনেক দূর থেকে শাহ আমানত সেতু দিয়ে ঘুরে আসতে হতো। এখন তারা সোজা টানেল দিয়ে বিমানবন্দরে যেতে পারবেন। এ ছাড়া, ঢাকা থেকে কক্সবাজারে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে সময় বাঁচবে এবং বাইপাসও হওয়া যাবে। ফলে চট্টগ্রামের যানজট নিরসন হবে।

 

 

জানা গেছে, নির্মাণের আগে করা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী পরিবহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সমীক্ষা দল। তিনি আশা প্রকাশ করেন এ টানেল দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির আরেক মাইল ফলক।

 

এ টানেল পারাপারে নির্ধারিত টোল ধরা হয়েছে যানবাহনভেদে ২০০ থেকে এক হাজার টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। টোল হার অনুযায়ী প্রাইভেট কার, জিপ ও পিকআপের টোল ২০০ টাকা করে। যদিও শাহ আমানত সেতুতে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য ৭৫ টাকা এবং জিপের জন্য ১০০ টাকা দিতে হয়। আর টানেল ব্যবহারে মাইক্রোবাসের জন্য ২৫০ টাকা দিতে হবে।

 

শাহ আমানত সেতুতে এ হার ১০০ টাকা। ৩১ বা এর চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ এবং ৩২ বা এর চেয়ে বেশি আসনের জন্য ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। যদিও শাহ আমানত সেতুতে যথাক্রমে ৫০ ও ১৫৫ টাকা নেওয়া হয়। টানেল দিয়ে যেতে হলে ৫ টনের ট্রাককে ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাককে ৫০০ টাকা এবং ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাককে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে।

 

তবে শাহ আমানত সেতুতে যথাক্রমে ১৩০, ২০০ ও ৩০০ টাকা টোল নেওয়া হয়। ট্রেইলরের (চার এক্সেল) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার টাকা। শাহ আমানত সেতুতে এ হার ৭৫০ টাকা। চার এক্সেলের বেশি হলে প্রতি এক্সেলের জন্য ২০০ টাকা করে দিতে হয়। এ নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তারা সহনীয় পর্যায়ে টোল বিবেচনার জন্য সড়ক ও সেতৃ কতৃপক্ষ ও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

 

 

এইচ এম কাদের,সিএনএন বাংলা২৪