ই-পেপার | মঙ্গলবার , ১৮ই জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

হেলালউদ্দিন চৌধুরী; টানা ৫০ বছর খবরের পেছনে ছুটে বেড়ানো শব্দসৈনিক

বিশেষ প্রতিবেদন :

 

সত্তর দশকের প্রথমভাগে সাংবাদিকতা পেশায় যাত্রা শুরু করেন কক্সবাজার-চট্টগ্রামের বর্ষীয়ান সাংবাদিক হেলালউদ্দিন চৌধুরী। সেই থেকেই পুরো জীবন সংবাদের পেছনে মাঠে-ঘাটে নিরন্তন ছুটে বেড়িয়েছেন তিনি। সংকট আর সমস্যার অন্তরালে তিনি খুঁজেছেন নাড়ি-নক্ষত্র। সেইসকল সমস্যা-সম্ভাবনার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর লেখনিতে। ৬৮ বছর বয়সে তাঁর সেই জীবনের ইতিও ঘটেছে সাংবাদিকতার মাঠে।

 

শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজারে আয়োজিত যায়যায়দিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান চলাকালে তিনি হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন। তারপর কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথমে সিসিইউতে এবং পরে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় থেমে যায় সংবাদের পেছনে অর্ধশত বছর ছুটে বেড়ানো জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক। কর্মজীবনের শেষ সময়ে দৈনিক যায়যায়দিনের ব্যুরো প্রধান ছিলেন তিনি।

 

হেলালউদ্দিন চৌধুরী, ১৯৫৫ সালে কক্সবাজার শহরের বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন টেকপাড়া এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে, সেসময়কার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’র কক্সবাজার সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর কক্সবাজার প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। তার পরের বছর ১৯৮১ সালে দৈনিক আজাদীর স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে চলে যান এই প্রবীণ সাংবাদিক। সেই থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতার দুই যুগ কাটিয়েছেন দৈনিক আজাদী পত্রিকায়। সেখানে সুনাম ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিলেন চিফ রিপোর্টারের দায়িত্বও। পরে জাতীয় দৈনিক সমকালের প্রতিষ্ঠাকালীন চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। পরে দৈনিক যায়যায়দিনের ব্যুরো প্রধানের দায়িত্ব পান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই তিনি কর্মরত ছিলেন।

 

সাংবাদিক হেলালউদ্দিন চৌধুরী সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক এম নাসিরুল হকের কাছে। তিনি বলেন, ‘সহকর্মী হিসেবে আমরা ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত একসঙ্গে কাজ করেছি। তার মতো সজ্জন ব্যক্তি কমই আছে। অত্যন্ত সৎ ও নিলোর্ভ ব্যক্তি ছিলেন হেলাল উদ্দিন।’

 

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর একসময়ের সহকর্মী, দৈনিক আজাদীর বর্তমান চিফ রিপোর্টার হাসান আকবর বলেন, ‘১৯৯৫ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত দশ বছর আমরা পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করেছি। উনি খুবই মানবিক মানুষ। একটা উদাহরণ দিই, আমার শ্বশুরবাড়ি রাজশাহীতে। আমার স্ত্রী মাঝেমাঝে সেখানে যেতেন। আমি যখন একা হয়ে যেতাম তখন আমার খাবারদাবার হোটেলে খেতে হতো। কিন্তু হেলাল ভাই কখনো আমাকে হোটেলে খেতে দিতেন না। উনার সঙ্গে বাসায় নিয়ে যেতেন। আমি উনার বাসায় খেতাম। শুধু এই ঘটনাতেই বুঝতে পারেন সহকর্মীর প্রতি উনার মমত্ববোধ কেমন।’

 

‘নির্ভীক, নির্লোভ ও ত্যাগী মানুষ ছিলেন হেলাল ভাই। চলে যাওয়ার দুইদিন আগেই কথা হয়েছে আমাদের। উনার সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্ক। হেলাল ভাই চলে যাওয়াতে আমি আমার একজন বড় ভাই হারালাম।’ — যোগ করেন এই সাংবাদিক।

 

সাংবাদিকতা ছাড়াও দক্ষ সংগঠক হিসেবে বেশ পরিচিতি ছিলো হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর। তিনি কক্সবাজার প্রেসক্লাবের ১২জন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে একজন এবং বয়সে তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর চট্টগ্রামে সম্মিলিত পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সচিব, চট্টগ্রাম সাংবাদিক হাউজিং সোসাইটির আহবায়ক ও সভাপতি, কক্সবাজার প্রেসক্লাব কার্যনির্বাহী কমিটির বিভিন্ন পদ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য, থ্যালাসেমিয়া সেবা কেন্দ্র চট্টগ্রামের সভাপতি পদসহ আরো নানা সংগঠন ও সংস্থার দায়িত্ব পালন করেছেন।

 

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বর্তমান সিনিয়র সহ-সভাপতি চৌধুরী ফরিদ বলেন, ‘সাংবাদিকদের স্বার্থ আদায়ে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন হেলাল ভাই। কোনো কিছুতে কখনো কম্প্রমাইজ করতেন না। সহকর্মী হিসেবে না পেলেও প্রেসক্লাবের সাংবাদিক নেতা হিসেবে সকল ধরনের পরামর্শ নিতাম। ভাইয়ের পরামর্শ নিয়েই কাজ করেছি আমরা। তাঁর চলে যাওয়া আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’

 

আশির দশকে চট্টগ্রামে সাংবাদিকতার আরেক অগ্রজ, দৈনিক পূর্বকোণের বার্তা সম্পাদক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রামে আশির দশকে পত্র-পত্রিকায় যারা সাংবাদিকতা করতো তাদের মধ্যে যে দুই তিনজন ভালো রিপোর্টার ছিল হেলাল একজন। অনেকে ঘরে বসে রিপোর্ট করতো। কিন্তু হেলাল ছিল মাঠের সাংবাদিক। মাঠে গিয়ে কষ্ট করে কাজ করতো। এককথায় একজন সত্যিকারের পরিশ্রমী ও মেধাবী সাংবাদিক ছিল হেলাল।’

 

প্রথিতযশা এই সাংবাদিক ছিলেন প্রয়াত জাকির হোসাইন চৌধুরী ও ফরিদা বেগম দম্পতির বড় সন্তান। মৃত্যুকালে হেলালউদ্দিন চৌধুরী মা, স্ত্রী এবং এক পুত্র রেখে গেছেন। ছেলে তাসনীম উদ্দিন চৌধুরী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।

 

এদিকে, শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) জোহরের নামাজের পর চট্টগ্রাম নগরের মিসকিন শাহ মাজার প্রাঙ্গণে হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।সূত্র:সিভয়েস।

 

এইচ এম কাদের,সিএনএন বাংলা২৪