ই-পেপার | রবিবার , ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৯ দিনব্যাপি মাহফিলে সিরাতুন্নবি (সা:) : মুসলিম উম্মাহ’র ঐক্যের প্লাটফর্ম

ইসলামিক বাংলা :

বুধবার সালাতুল যোহর পরবর্তী আরম্ভ হতে যাচ্ছে ঐতিহাসিক ১৯ দিনব্যাপী ৫৩ তম আন্তর্জাতিক মাহফিলে সীরতুন্নবী (সাঃ) মাহফিল।১৯৭২ থেকে আজ অবধি প্রায় ৫৩ বৎসর যাবৎ পরিচালিত হয়ে আসছে এই সীরতুন্নবী (সাঃ)মাহফিল।

 

কালের পরিক্রমায় মানুষ যখন ইসলামের মূল শিক্ষার বিপরীতে শিরক,বিদয়াত ও কুসংস্কারে বেড়াজালে জড়িয়ে পড়েছিল ঠিক উপযুক্ত সময়ে দিশেহারা মানুষদের ইসলামের সঠিক জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে হযরত শাহ সাহেব কেবলা (রা:) এই মাহফিলের গোড়াপত্তন করেন।ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলীর বিশদ বর্ণনা সর্বস্তরের মানুষের নিকট পৌছানোর ক্ষেত্রে চুনতী সীরাত মাহফিল দীর্ঘ সময়ব্যাপী তাবলীগে দ্বীনের জন্যে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।

 

১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরাতের প্রতিষ্ঠাতা, প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হযরত শাহ হাফেজ আহমদ (রাহঃ) আলেম-উলামাদের পদচারণায় ধন্য দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামে ১৯০৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি ইলমে শরীয়তের প্রাথমিক শিক্ষা পারিবারিক পরিমন্ডলে পিতামহ মুফতি মাওলানা কাজী ইউছুফ (রাহঃ)থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন।পরবর্তী উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন।হযরত শাহ হাফেজ আহমদ (রাহঃ)ইলম,আমল,ইমান ও ইবাদতের জন্যে সবসময় মহান আল্লাহ তা’আলার দরবারে শুকরিয়া প্রকাশ করতেন।হযরত শাহ হাফেজ আহমদ (রাহঃ)শিক্ষা পরবর্তী জীবনে মায়ানমার সফরে গেলে উনার ইলম,আমল, আখলাখ সর্বোপরি মা’,আলোমাত ভালো দেখে সেখানকার অধিবাসীরা খতিবের দায়িত্ব অর্পণ করেন।তিনি মায়ানমার (বাম্মু) শহরের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ দীর্ঘদিন খতিবের দায়িত্ব পালন করেন।হযরত শাহ হাফেজ আহমদ (রাহঃ)তার প্রবর্তিত সীরাতুন্নবী (সাঃ)মাহফিলের সুন্দর ব্যবস্হাপনার জন্যে গড়ে গেছেন ১৩ একর বিশিষ্ট সীরাত ময়দান। সীরাত ময়দানের পশ্চিম পাশে উনার অভিপ্রায় অনুযায়ী নির্মিত হয় সুরম্য জামে মসজিদ “মসজিদে বায়তুল্লাহ”।

 

হযরত শাহ হাফেজ আহমদ (শাহ সাহেব রাহঃ)১৯৮৩ সালে অসংখ্য ভক্ত ও গুনগ্রাহীকে রেখে দুনিয়ার সফর শেষ করে মহান আল্লাহ তা’আলার সাক্ষাৎ লাভ করেন।মসজিদ বায়তুল্লাহ দক্ষিণ পাশে অবস্থিত “মাক্ববরা”য় তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। উম্মাহ’র জন্যে কালজয়ী এই সীরাত সর্বোপরি সাদকায়ে যারিয়াহ রেখে যাওয়ার জন্যে মহান আল্লাহ তা’আলা উনাকে জান্নাতের উচ্চাসনে সমাসীন করুন। আমীন।

ইসলামি বর্ষপঞ্জি অনুসারে রবিউল আওয়াল হিজরি নববর্ষের তৃতীয় মাস।ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রবাহের কারণে মাসটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ও ইতিহাসের পাতায় অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ট মহানায়ক সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)এর জন্ম ও ওফাত।

 

অন্যান্য নবি ও রাসুলদের কে আল্লাহ তা’আলা নির্দিষ্ট জাতি, গোষ্টির বা বিশেষ অঞ্চলের জন্যে প্রেরণ করেছেন।অপরদিকে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ট নবী
জাতি ধর্ম,বর্ণ,গোত্র নির্বিশেষে পুরো জগতের রাহমাত হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)।

 

মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ইরাশাদ করেন..
★وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ (107)
হে নবী আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রাহমাত হিসেবে প্রেরণ করেছি। (সুরা আম্বিয়াঃ১০৭)
★لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيراً

যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। (সুরা আহযাবঃ২১)
★ قُلۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰهَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰهُ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۳۱﴾﴾

বল, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’।

 

(আল-বায়ান)
রাসুল (সাঃ)এর জীবনব্যাপি ঘটনা মুসলিম উম্মাহ’র সামনে তুলে ধরার জন্যে রবিউল মাসে ১৯ দিনব্যাপী সীরতুন্নবী (সাঃ)এর শুভ সূচনা করেন শাহ হাফেজ আহমদ প্রকাশ শাহ সাহেব কেবলা (রাহঃ)।

সীরাত আরবি শব্দ এর অর্থ চরিত্র, জীবন ব্যবস্হা,জীবনের অবলম্বন, জীবন ব্যাপী ঘটনাবলী। যেখানে রাসুল (সাঃ)এর জীবনব্যাপী ঘটনার বিশদভাবে বর্ণনা করা হয় তাই হলো সীরতুন্নবী (সাঃ)।

 

ঐতিহাসিক এই সীরাত মাহফিল গতানুগতিক ধারার কোন মাহফিল নয় বরং এটি সাধারণ মানুষদের প্রয়োজনীয় ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য উন্মুক্ত এক শিক্ষাকেন্দ্র। এই উন্মুক্ত শিক্ষাকেন্দ্রে এসে সর্ব স্তরের মুসলিম জনতা তাদের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ের সঠিক সমাধান পেয়ে থাকেন।যার মাধ্যমে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামি রূপরেখার আলোকে সাজানোর প্রয়াস পান।

মাহফিলে দেশের বিভিন্ন জায়গার সরকারি ও কওমি ধারার আলেমরা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর কোরআন ও হাদিসের আলোকে সারগর্ভ আলোচনা করে থাকেন।এই মাহফিলে মাসয়ালা-মাসায়েল সহ সময়োপযোগী যুগ জিজ্ঞাসার জওয়াব উম্মাহ পেয়েথাকে।

 

মাহফিলে ১৯ দিনব্যাপি প্রায় ৭০ টির উর্ধে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করাহয়।প্রত্যেক ওয়ায়েজের পাশাপাশি ছদারতের দায়িত্ব পালন করেন দেশবরেণ্য অনেক আলোমেদ্বীন।

 

যেখানে হযরত মুহাম্মদ (সা:) জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তথা হয়াতে জিন্দেগির পুরো বিষয় সহ বর্তমান প্রক্ষাপটে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেয়াহয়।নির্দিষ্ট দিনের প্রতিটি ওয়ায়েজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর সর্বোচ্চ প্রস্ততি নিয়ে কোরআন -হাদিস ভিত্তিক আলোচনা পেশ করেন।

 

বিভিন্ন জায়গায় মাহফিলে তাদের নিজস্ব মতাদর্শের আলেমদের দাওয়াত দেয়াহয় চুনতির মাহফিল এ ক্ষেত্রে ভিন্ন কারণ হযরত শাহ সাহেব কেবলা (রা:)নিজেই সংকীর্ণতার উর্ধে ছিলেন।তিনি মুসলমানদের বৃহত্তর ঐক্যের জন্যে সরকারি ও কওমি ধারার হক্কানি আলেমদের সমন্বয়ে এই মাহফিল আরম্ভ করেন।বর্তমান নানাবিধ ফুরুআত নিয়ে উম্মাহ’র অনৈক্য চুনতী সীরাত মাহফিল পুরো বিশ্বে অনন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

 

যার মাধ্যমে আলেমরা একই মঞ্চে উঠে কোরআন হাদিসের আলোকে আলোচনা ও পরস্পরের মধ্যে আন্তরিকতার মিলন ঘঠাতে পারেন।নিজেকে সংকীর্ণ মনোবৃত্তির উর্ধে তোলে সকল ঘরনার আলেমদের নিয়ে জাতীয় ঐক্যের চিন্তা করতে পারেন।

 

হযরত শাহ সাহেব কেবলা (রাহঃ)এর সাথে থেকে সূচি সাজানো,প্রয়োজনীয় বিষয় নির্ধারণ,মাহফিলের নামকরণসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে সহায়তা করেন উপমহাদেশের তৎকালীন বরেণ্য আলেমেদ্বীন হযরত আল্লামা ফজলুল্লাহ (রাহঃআ.)।

 

চুনতী সীরতুন্নবী (সাঃ)মাহফিলের সঞ্চালনা,যুগোপযোগী বিষয় নির্ধারণ ও নানাবিধ কাজে বর্তমানেও সময়োপযোগী উচু মাপের আলেমদের সরব পদচারণা বিদ্যমান আছে।

 

হযরত শাহ সাহেব কেবলা (রা:) শরীয়তের যথাযথ অনুসারী আলেম, কামেল ওলী, মুজাদ্দিদ, আল্লার মাকবুল একজন বান্দা ছিলেন।উনার জীবদ্দশায় অসংখ্য কারামাত প্রকাশিত হয়েছে যা স্বচক্ষে দেখেছেন এমন অনেকে বেচে আছেন।আর হযরত শাহ সাহেব কেবলা (রাঃ)এর সবচেয়ে বড় কারামাত ও অনবদ্য কীর্তি ঐতিহাসিক ১৯ দিনব্যাপী সীরতুন্নবী (সাঃ)মাহফিল। রাসুল (সাঃ) এর প্রতি যে গভীর ভালবাসা উনার ছিলো তার বহিঃপ্রকাশ নিম্নোক্ত পংক্তিগুলি পড়লে সহজে বুঝা যায়।

 

হযরত শাহ সাহেব কেবলা (রাহঃআ)শহর,বন্দরে, পাহাড়, অরণ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় নিম্ন পংক্তিগুলো বারংবার পড়তেন… “হাম মাজারে মুহাম্মদ (সা.)পে মর জায়েঙ্গে, জিন্দেগি মে য়াহি কাম কর জায়েঙ্গে” অর্থঃহযরত মুহাম্মদ (সাঃ)এর উদ্দেশ্যে আমার জীবন উৎসর্গিত,সারা জীবন তার ধ্যানেই আমি থাকব নিয়োজিত।

 

মুসলমানরা এক সময় বিশ্ব শাসন করেছিল।পুরো পৃথিবী জুড়ে আধিপত্য ছিল মুসলমানদের। ইতিহাসের পাতায় বীরত্বপূর্ণ এ শাসনামলের বর্ণনা আমরা দেখতে পায়।আজকে মুসলমানরা অধিকার বঞ্চিত,বিপর্যস্ত,পর্যদুস্ত।তার মূল কারণ হল রাসুল (সাঃ) যাদের শরীরের একটি অংশের সাথে তুলনা করেছেন সে মুসলমানরা নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে ইসলামের মূল রূপরেখা বা আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।

 

বিভক্ত উম্মাহ’কে কোরআন-সুন্নাহ’র যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে একই পতাকাতলে সমবেত করে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে হযরত শাহ হাফেজ আহমদ প্রকাশ সাহেব কেবলা (রাহঃআ) ১৯ দিনব্যাপী ঐতিহাসিক সীরাত মাহফিলের গোড়াপত্তন করেন।

★اﻻ تفاق مع اﻻ ختلاف
তথা (মতানৈক্য সহকারে একমত) হওয়াটাই এখন সময়ের দাবী।

রাসূল (সাঃ)বলেন,

,★تَرَى المُؤْمِنِيْنَ فِيْ تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالحُمَّى، ‘মুমিনদের দৃষ্টান্ত তাদের পারস্পরিক সম্প্রীতি, দয়ার্দ্রতা ও সহমর্মিতার দিক দিয়ে একটি দেহের মত। যখন তার কোন একটি অঙ্গ অসুস্থ হয়, তখন তার সমগ্র দেহে তাপ ও অনিদ্রা ডেকে আনে’।[5]

শিরক ও বিদয়াত মুক্ত ইমান ও আমলের মাধ্যমে সরকারি ও কাওমি আলেমদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য ও ইসলামের প্রচার প্রসারের জন্যে চুনতি সিরাত মাহফিল অনন্য এক প্লাটফর্ম। সর্বোপরি মাহফিলকে সামনে রেখে দেশের প্রত্যান্ত জায়গায় যারা মাহফিলের প্রচারের জন্যে খেদমত করেছেন মাহফিল উপ -কমিটি,যারা মাহফিলের জন্যে অর্থের যোগানদিচ্ছেন,শারীরিক শ্রম দিচ্ছেন এবং মাহফিল সফল করার লক্ষ্যে যার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মহান রব সকলের কাজের উত্তম প্রতিদান দান করুণ।

 

ঐতিহাসিক ১৯ দিনব্যাপী ৫৩ তম সীরাতুন্নবী (সা:)মাহফিল সফল ও সার্থক হোক এবং এ মাহফিল যেন কিয়ামত পর্যন্ত জারিথেকে মুসলিম উম্মাহ’র জন্যে সঠিক পথের পাথেয় হয়। আমিন।

 

 

এইচ এম কাদের,সিএনএন বাংলা২৪