ই-পেপার | সোমবার , ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

এক যুগে দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে ৪৬ শতাংশ

নিজস্ব প্রতিবেদক,বরিশাল:

এক যুগে বরিশাল বিভাগের নদ-নদীতে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। সরকারের বেশ কয়েকটি উদ্যোগে মৎস্য সম্পদের এই উন্নতি যেমন জাতীয় অর্থনীতিতে সবুজ সংকেত দিচ্ছে তেমনি জেলেদেরও জীবনযাত্রার মান ফিরিয়েছে। যদিও সরকারি সহায়তা বণ্টন নিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, সামনে ইলিশ সম্পদে আরও সমৃদ্ধি আসবে। আর চলতি মৌসুমে বিগত দিনের রেকর্ড ভাঙবে ইলিশের উৎপাদন।

জেলেদের দাবি, সরকারি সহায়তা প্রকৃত জেলেদের হাতে পৌঁছাতে টাস্ক ফোর্স গঠন করতে হবে।

বিভাগীয় মৎস অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন জানিয়েছেন, বরিশাল বিভাগে ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৭৬২ মেট্রিক টন। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ নদীতে ৬১ হাজার ২৭২ মেট্রিক টন ও সমুদ্রে ১ লাখ ৯ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন।

 

২০১১-১২ অর্থবছরে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৭৭ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ নদীতে ৬৫ হাজার ৮৩৬ মেট্রিক টন এবং সমুদ্রে ১ লাখ ১০ হাজার ১৪১ মেট্রিক টন।

 

২০১২-১৩ অর্থবছরে এই বিভাগে মোট ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৭৬ মেট্রিক টন। যার মধ্যে নদীতে ৫৪ হাজার ৮৪৯ মেট্রিক টন এবং সমুদ্রে ১ লাখ ১২ হাজার ১৩৬ মেট্রিক টন।

 

২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট ২ লাখ ২১ হাজার ৫৯৮ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ নদীতে ৭১ হাজার ৭৬৭ মেট্রিক টন এবং সমুদ্রে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮৩১ মেট্রিক টন।

 

২০১৪-১৫ অর্থবছরে উৎপাদিত হয় ২ লাখ ৫৩ হাজার ১৮১ মেট্রিক টন ইলিশ। যার মধ্যে নদীতে ৮৮ হাজার ২৫ মেট্রিক টন ও সমুদ্রে ১ লাখ ৬৫ হাজার ১৫৬ মেট্রিক টন।

 

২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৫৮ হাজার ২২৫ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে নদীতে ৯১ হাজার ৪৯৮ মেট্রিক টন এবং সমুদ্রে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭২৭ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়।

 

২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ইলিশ উৎপাদিত হয় ৩ লাখ ২৪ হাজার ২৯৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ নদীতে ১ লাখ ৪১ হাজার ৩৪০ মেট্রিক টন এবং সমুদ্রে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৫৭ মেট্রিক টন।

 

২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ইলিশ উৎপাদিত হয় ৩ লাখ ২৯ হাজার ২৫ মেট্রিক টন। এর মধ্যে নদীতে উৎপাদিত হয় ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৭৮ মেট্রিক টন এবং সাগরে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪৭ মেট্রিক টন।

 

২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ইলিশ উৎপাদিত হয় ৩ লাখ ৪১ হাজার ১১৯ মেট্রিক টন। এর মধ্যে নদীতে উৎপাদিত হয় ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৪১ মেট্রিক টন ও সাগরে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৭৮ মেট্রিক টন।

 

২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯২৭ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে নদীতে উৎপাদিত হয় ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৫ মেট্রিক টন ও সমুদ্রে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৭২ মেট্রিক টন।

 

২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৩০১ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ নদীতে উৎপাদিত হয় ১ লাখ ৬৫ হাজার ২৯২ মেট্রিক টন এবং সমুদ্রে ২ লাখ ৪ হাজার ৯ মেট্রিক টন।

 

২০২১-২২ অর্থবছরে মোট উৎপাদিত ইলিশের পরিমাণ ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫১ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সালের মৎস্য উৎপাদনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- এই ১২ বছরের ব্যবধানে ৪৬ শতাংশ উৎপাদন বেড়েছে।

 

বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, ২০০৪ সালে জাটকা নিধন রোধ ও ২০০৯ সালে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান শুরু হয়। এরপর থেকেই ইলিশের উৎপাদন বাড়তে শুরু করে বরিশাল বিভাগে। এ বছরের আবহাওয়া ইলিশ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। ২০ জুলাই সাগরে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শেষ হচ্ছে। আমরা আশা করছি বিগত দিনের চেয়ে এই মৌসুমে বেশি ইলিশ পাওয়া যাবে।

 

জেলা মৎস্য কর্মকতা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ঋতুর অনেক পরিবর্তন এসেছে। যে কারণে জুন-জুলাই মাসে বর্ষা আশানুরুপ হয় না। তাছাড়া এখন সমুদ্রে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। তবে নদীতে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা নেই। সমুদ্রের ইলিশ ধরা বন্ধ থাকায় ইলিশ বাজারে কম। এটি স্বাভাবিক ঘটনা।

 

তিনি বলেন, ইলিশ মাছ উজান পারি দিতে পছন্দ করে। আর ঠান্ডা পানিতে তারা ওপরে উঠে আসে। আবহাওয়া পরিবর্তনে এখন উজানের স্রোত কম। তাছাড়া বৃষ্টি যা হচ্ছে তাতে পানির উপরিভাগই ঠান্ডা হচ্ছে না। এজন্য ইলিশ পানির তলদেশে রয়েছে। উজানের স্রোত বাড়লে আর পানির তাপমাত্রা কমে আসলে ওপরে উঠে আসবে ইলিশ। তখন জালেও আশানুরুপ মাছ পাওয়া যাবে।

 

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার বলেন, জুন-জুলাইতে ইলিশ কম পাওয়া যাবে এটিই স্বাভাবিক। এখনতো মাছ সমুদ্রে। নদীতে উঠে আসার সঠিক সময় এখন না। ইলিশ নেই এমন ধারণা ভুল। বরং বিগত দিনের তুলনায় বর্তমানে ইলিশের পরিমাণ ও আকার বড়। পর্যালোচনা অনুযায়ী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ইলিশ পাওয়া যাবে। তখন সমুদ্রে ও নদীতে নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।

জেলেদের বিস্তর অভিযোগ

বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সন্ধ্যা নদী তীরের মিরেরহাট এলাকার বাসিন্দা ইউসুফ হাওলাদার বলেন, নিষেধাজ্ঞার সময়ে আমরা যারা জেলে তারা নদীতে নামতে পারি না। কিন্তু এলাকার নেতারা মৎস্য অফিসারকে ম্যানেজ করে লোক দিয়ে মাছ ধরায়। এ নিয়ে অনেক বার কথা বলে নিজে এলাকায় থাকতে পারিনি। আমাদের জন্য সরকার যে কয় কেজি চাল বরাদ্দ দেয়, সেই চালটুকুও সঠিক মাপে পাই না।

 

একই নদীর জেলে আব্দুল হালিম বলেন, জেলেদের জন্য যে চাল বরাদ্দ তা দিয়ে ১৫ দিনও চলা যায় না। তারপরও সন্তুষ্ট থাকতাম যদি সেই চাল সঠিক মাপে পেতাম। সরকার দেয় আমাদের জন্য, মাঝখানে চাটার দল খেয়ে ফেলে। আমরা না থেয়েই থাকি।

 

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক গ্রামের জেলে ছগির বলেন, নদী-সাগরে মাছ বেড়েছে এটা সত্য। কিন্তু সারাবছর এই নিষেধাজ্ঞা, সেই নিষেধাজ্ঞা লেগেই থাকে। ৩৬৫ দিনের মধ্যে ভালোভাবে ৬৫ দিনও আমরা মাছ ধরতে পারি না। জেলেদের বরাদ্দের চাল পাই না। নেতাদের সুপারিশে মৌসুমি জেলেরা চাল নিয়ে যান।

 

পাথরঘাটার নাচনাপাড়া এলাকার বাসিন্দা শাহিন বলেন, জেলেদের সহায়তার চাল নিয়ে যদি মেম্বার-চেয়ারম্যান নয়ছয় না করতেন তাহলে আমরা অবরোধের কয়দিন কম হলেও কিছু খেয়ে থাকতাম।

 

বরগুনা মৎসজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি চৌধুরী গোলাম মোস্তফা বলেন, ইলিশ রক্ষা অভিযান যেমন চলছে তেমনি জাটকা ও মা ইলিশ নিধন হচ্ছে দেদারছে। এতে করে সামনের দিনগুলোতে ইলিশ আমরা পাব কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। তাছাড়া জেলেদের মাঝে সঠিকভাবে সহায়তা বণ্টন হলে জেলেরা ভালো থাকতো। আমরা এসব বিষয় নিয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন মহলে বারবার বলেছি। কার্যকর পদক্ষেপ এখনো পাইনি। তবে আশাবাদী তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

এইচ এম কাদের,সিএনএন বাংলা২৪: