ই-পেপার | মঙ্গলবার , ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মশার উৎপাত: ডেঙ্গু মৌসুম ঘিরে খুলনায় উদ্বেগ

নিজস্ব প্রতিবেদক,খুলনা:

সিটি মেয়র জানান, এডিস মশা বা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি।

 

খুলনা নগরীতে দিনরাতে মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় অতিষ্ঠ জনজীবন। দিনেও মশারি বা কয়েল জ্বালিয়ে থাকতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এতে চরম ভোগান্তির পাশাপাশি মানুষের দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে ডেঙ্গুর মৌসুমকে ঘিরে নগরবাসীর মধ্য উদ্বেগ বাড়ছে।

 

তাদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ নালা-নর্দমা ও খাল নিয়মিত পরিষ্কার না করায় মশার প্রজননস্থলে পরিণত হয়েছে।

 

এদিকে সিটি করপোরেশন বলছে, শীতকালে যখন বৃষ্টি থাকে না, তখন ডোবা-নর্দমার পানি ঘন হয়ে পানিতে জৈব উপাদান বেড়ে যায়। এ সময় প্রচুর কিউলেক্স মশার প্রজনন ঘটে; যে কারণে এ সময় মশা বেড়ে যায়। তবে বৃষ্টিপাত শুরু হলে মশার উপদ্রব কিছুটা কমবে।

 

এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, “বর্তমানে মশার ঘনত্ব বেড়েছে নগরের সর্বত্র। দিনের বেলাও মশারি টানিয়ে বা কয়েল জ্বালিয়ে থাকতে হচ্ছে মানুষকে। ঘরোয়াভাবে মশা তাড়ানোর কোনো ফর্মুলাই কাজে আসছে না।”

 

বছরজুড়ে বিস্তার লাভ করা মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা খুবই কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখন ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়েছে। এ সময় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা থেকে সতর্ক থাকাটা বেশি জরুরি। সিটি করপোরেশন নগরের নালা-নর্দমা ও খাল নিয়মিত পরিষ্কার এবং বর্জ্য অপসারণ না করায় এই নগরী এখন মশার প্রজননস্থলে পরিণত হয়েছে।”

 

এডিস মশার লার্ভা শনাক্ত এবং মশক নিধনে খুলনা সিটি করপোরেশনের তেমন সক্ষমতা নেই। কোন এলাকায় মশার বংশবিস্তার কেমন বা লার্ভা বেশি, সে বিষয়ে ধারণা নেই সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের বলে জানান তিনি।

 

আশরাফ উজ জামান বলেন, “ঢাকা-চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য বিভাগ এবং আইইডিসিআরের সহায়তায় কোন এলাকায় লার্ভার ঘনত্ব কত, তা জানতে জরিপ হয়েছে। কিন্তু খুলনায় তা হয়নি। আবার মশক নিধনে সিটি করপোরেশন এখনও পুরাতন ওষুধ এবং ফগার মেশিনের ওপর নির্ভর। নতুন ওষুধ আনার উদ্যোগও নেই। মশক নিধনে যতটুকু তৎপরতা চালানো হচ্ছে, তা যথেষ্ট নয়।”

 

প্রতিবছরই এ সময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সময় মত ব্যবস্থা নিলে নগরবাসীকে মশার এমন উপদ্রব সইতে হয় না। এবারও ডেঙ্গু আতঙ্কেই কাটাতে হবে নগরবাসীকে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, “সঠিক সময়ে মশার প্রজনন রোধ করতে না পারায় নগরে মশার প্রকোপ ব্যাপক বেড়েছে। মশার যন্ত্রণায় নগরবাসী অতিষ্ঠ।

বাসাবাড়ি-কর্মস্থান কোথাও নিস্তার মিলছে না।”

 

পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, “নিয়মিত পরিচ্ছন্নতার অভাবে নগরের নালা-নর্দমা-খালে পানি জমে থাকছে, ঝোপ-ঝাড়ও সঠিকভাবে পরিষ্কার হচ্ছে না।

 

“এ ছাড়া গৃহস্থালি বর্জ্যের স্তূপ, রাস্তার পাশের টায়ারের দোকান, দীর্ঘদিন ফেলে রাখা মোটরযান, ঢালাই মেশিন, মার্কেটের পরিত্যক্ত ছাদ, দুই বাড়ির মাঝে জমে থাকা বৃষ্টির পানি ও ভবনের টাঙ্কির পানিতে মশা জন্মে নিচ্ছে।”

 

মশার উৎপাত: ডেঙ্গু মৌসুম ঘিরে খুলনায় উদ্বেগ
এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা খুবই কম। যে কারণে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বর্তমানে নগরে মশার প্রকোপ বেড়েছে বলে জানান তিনি।

 

এদিকে, মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে খুলনা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণ একটি বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ। প্রজনন মৌসুম বুঝে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

 

তিনি বলেন, মশার বংশবৃদ্ধি রোধে শহরের নালায় ৮০ শতাংশ ডিজেল ও ২০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল মিশিয়ে তেল ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে প্রায় মাসখানেক আগে থেকে ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালানো হচ্ছে। ৩১টি ওয়ার্ডে দুইজন করে কর্মচারী মশা নিধনে ফগার ও স্প্রে ছিটাতে কাজ করছেন।

 

আনিসুর বলেন, নগরের বিভিন্ন এলাকায় নালা নির্মাণ এবং সংস্কারের কাজ চলছে। এতে পানিপ্রবাহ বন্ধ রয়েছে। আর আটকে থাকা ওই পানিতে মশার প্রজনন বাড়ছে। অন্যদিকে অসচেতনভাবে অনেকে নালায় আবর্জনা ফেলেন। এ কারণে পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

 

নালা নির্মাণ এবং সংস্কার কাজের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের আধুনিক বর্জ্য পরিশোধনাগার নির্মাণ শেষ হলে নগরের বর্জ্য দ্রুত অপসারণ হবে। এতে মশার উপদ্রব কমে আসবে বলে জানান সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এই কর্মকর্তা।

 

নগরের বয়রা, রায়েরমহল, সোনাডাঙ্গা, করিমনগর, গোবরচাকা, মহিবাড়ি খালপাড়, রায়পাড়া, রূপসা, নিরালা, নাজিরঘাট, গল্লামারীসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওইসব এলাকায় সারা বছরই মশার উপদ্রব আছে। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই মশার প্রকোপ বেড়েছে। মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা নেই বলে দাবি তাদের।

 

স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, ছয় মাসে বেশিরভাগ সময় তারা এলাকায় মশা নিধনের কোনো কার্যক্রম দেখেননি। নালায় কোনো কীটনাশক দেওয়া হয়নি। ফগার মেশিনের শব্দও কেউ পাননি।

 

মশার উৎপাত: ডেঙ্গু মৌসুম ঘিরে খুলনায় উদ্বেগ
বয়রা এলাকার বাসিন্দা শাহ আলম শেখ বলেন, “গত ছয় মাসের মধ্যে একদিনও সিটি করপোরেশনের কাউকে মশা মারতে দেখেনি। ফগার মেশিনের আওয়াজও শুনিনি। সিটি করপোরেশন কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়াতেই মশার এমন প্রকোপ বেড়েছে।”

 

খালিশপুরের নয়াবাটি এলাকার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, “মশার কারণে ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারছে না। কয়েল, স্প্রে, ইলেকট্রিক ব্যাট ব্যবহার করেও মশার উৎপাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। মশা তাড়াতে ঘরে কয়েল জ্বালালে ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে; শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।”

 

সোনাডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন খোন্দকার বলেন, “অফিস, রাস্তাঘাট সব জায়গাতেই মশা ঘিরে ধরে। সন্ধ্যার পর স্থানীয় দোকানগুলোতে বসা যায় না। মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের কোনো ব্যবস্থাই চোখে পড়ে না।”

 

ইকবাল নগর এলাকার বাসিন্দা লুৎফুন্নাহার ডেইজি বলেন, “মশাবাহিত রোগে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে। আমার তিন বছরের ছেলেটাকে মশা বেশি কামড়ায়। মশার কামড়ে ওর গায়ে কালো দাগ হয়ে গেছে। মশা গায়ে বসলে ও বুঝতেও পারে না, বলতেও পারে না।”

 

খুলনা জেলা সিভিল সার্জন সবিজুর রহমান বলেন, সাধারণত বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ সময় ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার ও মশার বংশবিস্তার রোধ করা প্রয়োজন।

 

মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন করার উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সক্রিয় হয়ে মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি।

 

সবিজুর বলেন, “ডেঙ্গু একটি ভাইরাস জ্বর, এর থেকে সুস্থ হতে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের কোনো প্রয়োজন নেই। ডেঙ্গু জ্বর হলে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। খুলনার জেলা-উপজেলার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্ত এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।”

 

খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, “বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক হওয়ায় মানুষ এ সময় অতি সতর্ক থাকেন। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

 

সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে উল্লেখ করে সিটি মেয়র বলেন, “এডিস মশা বা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি। এ লক্ষ্যে বাড়ির আশপাশ এবং নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখতে হবে। নালা-নর্দমায় আবর্জনা পড়ে পানি সরবরাহ বন্ধ হলে সেখানে মশার লার্ভা সৃষ্টি হয়। আর সেখান থেকেই মশার উৎপত্তি হয়।”