অ্যাডভোকেট মোবারক হোসাইন সাঈদ
সাধারণ ভুক্তভোগীরা আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যেখানে প্রাণপণ লড়াই করতে থাকেন, ঠিক ব্যতিক্রমি কিছু মামলাবাজ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যও মিথ্যা অভিযোগ কিংবা মামলা দায়ের করে থাকে। তারা ওই মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরী ও সাক্ষ্যদানে জুড়িশিয়াল ব্যবস্থাকে মামলার ভারে আক্রান্ত করে রাখে। এতে বিচারব্যবস্থায় জটিলতা তৈরি হয়। তৈরি হয় মামলার দীর্ঘসূত্রিতা। এখানে মিথ্যা অভিযোগ বা মিথ্যা মামলা দায়ের করার দায়ে আইনে প্রদত্ত শাস্তির বিধানাবলী সবিস্তারে আলোকপাত করা হয়েছে।
বৃটিশ শাসনামলে প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ২৫০ ধারায় মিথ্যা অভিযোগের শাস্তির বিধান রয়েছে।
(ক) ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামিকে খালাস দেওয়ার সময় প্রমাণ পান যে, মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীকে কারণ দর্শানোর নোটিশসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন।
(খ) দণ্ডবিধির ২০৯ ধারা মতে, কেউ মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করলে তাকে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। অধিকন্তু,২১১ ধারায় মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দায়ের করার শাস্তির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে কোনো অভিযোগ দায়ের করলে অথবা কোনো অপরাধ সংঘটিত করেছে মর্মে মিথ্যা মামলা দায়ের করলে মামলা দায়েরকারীকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করারও বিধান রয়েছে।
(গ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১৭(২) ধারায়ও মিথ্যা মামলা দায়েরের শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। এখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কারও ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে এই আইনের অন্য কোনো ধারায় মামলা করার জন্য আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন অথবা কাউকে দিয়ে মামলা দায়ের করান, তবে সেই অভিযোগকারী অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
(ঘ) দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ধারা ২৮ গ (১) এ বলা হয়েছে, মিথ্যা জেনে বা তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কোনো ব্যক্তি ভিত্তিহীন কোন তথ্য প্রদান করে এবং যে তথ্যের বিত্তিতে কোন তদন্ত বা বিচার কার্য পরিচালনার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তিনি মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছেন বলে গণ্য হবেন। উক্ত অপরাধের জন্য তিনি অন্যূন ২ বছর বা অনধিক ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
(ঙ) শিশু আইন, ২০১৩ এর ৮৩ ধারা মতে কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোন মামলার কার্যক্রমে কোন আদালতে কোন শিশুর সম্পর্কে যদি এমন কোন তথ্য প্রকাশ করেন যা মিথ্যা, বিরক্তিকর বা তুচ্ছ প্রকৃতির, তাহলে আদালত প্রয়োজনীয় তদন্ত এবং শোকজ সাপেক্ষে কারণ লিপিবদ্ধ করে যার বিপক্ষে উক্ত তথ্য প্রদান করা হয়েছে তাকে ২৫ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে যেকোন পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদান করার জন্য সংশ্লিষ্ট মিথ্যা তথ্য প্রদানকারীর প্রতি নির্দেশ প্রদান করতে এবং অনাদায়ে অনধিক ৬ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন।
(চ) পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ সালের ১৩ (১) ধারা: সর্বোচ্চ ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড।
(ছ) পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, ধারা ৩২: অনধিক ১ বছর কারাদন্ড অথবা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ড।
(জ) যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮, ধারা ৬: অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন।
(ঝ)এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২, ধারা ৮: সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
(ঞ) আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২,ধারা ৬: অন্যুন দুই বছর এবং অনধিক পাঁচ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। ক্রান্তি কথায় বলতে চাই, মিথ্যা অভিযোগ বা মামলা দায়ের করণও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যেমন শাস্তিযোগ্য অপরাধ তেমনি ধর্মীয় আইনেও এটি মারাত্মক অপরাধ। একটি মিথ্যা অভিযোগ/মামলা, মিথ্যা স্বাক্ষ্য দ্বারা একটি নিষ্পাপ ব্যক্তির জীবনের সাথে সাথে একটি পুরো পরিবারেরও কিন্তু মৃত্যু ঘটে। কাজেই আমাদের সকলের উচিত মিথ্যা অভিযোগ বা মামলা ও মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত থাকা। নতুবা ঈদগাঁও উপজেলার রুনা ইসলামের মতো মিথ্যা মামলা দায়েরের ফলে চরম সাজা ভোগ করতে হবে।
মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরী ও সাক্ষ্যদানে শাস্তির বিধিবিধান:
দণ্ডবিধির একাদশ অধ্যায়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দান, মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি এবং মিথ্যা সাক্ষ্য ও সাক্ষ্যদানের শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি বিচারিক প্রক্রিয়ার যেকোন পর্যায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্যদান বা সাক্ষ্য বিকৃত বা উদ্ভাবন করেন তবে উক্ত ব্যক্তির সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। তবে বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্যদান বা সাক্ষ্য বিকৃত বা উদ্ভাবন করলে তিন বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। দণ্ডবিধিরি ১৯৪ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি এমন কোন মামলায় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্যদান বা বিকৃত বা উদ্ভাবন করেন, যে মামলার শাস্তি মৃত্যুদন্ড তবে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। কিন্তু যদি মিথ্যা সাক্ষ্য দান বা বিকৃত বা উদ্ভাবনের ফলে যদি কোন নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, তাহলে মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ক্রান্তি কথায় বলা যায়, মিথ্যা অভিযোগ বা মামলা দায়ের ও মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরী-সাক্ষ্যদানে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যেমন শাস্তিযোগ্য অপরাধ তেমনি ধর্মীয় আইনেও এটি মারাত্মক অপরাধ। একটি মিথ্যা অভিযোগ বা মামলা, মিথ্যা স্বাক্ষ্য দ্বারা একটি নিষ্পাপ ব্যক্তির জীবনের সাথে সাথে একটি পুরো পরিবারেরও কিন্তু মৃত্যু ঘটে। কাজেই আমাদের সকলের উচিত মিথ্যা অভিযোগ বা মামলা ও মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত থাকা।
অতি সম্প্রতি, মিথ্যা মামলা দায়ের করায় বাদীকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের নুরুল ইসলামের মেয়ে রুনা আক্তারকে এই দণ্ড দেওয়া হয়। এই বাদীনি তাকে কক্সবাজার আদালত চত্বর থেকে উঠিয়ে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ আনে তার নিজের স্বামী ফিরোজ আহমদসহ চারজনের বিরুদ্ধে। তদন্তে ওই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পরবর্তীতে আসামিদের একজন বাদী হয়ে রুনা আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালত সেই মামলায় রুনা আক্তারকে এই সাজা দেন।
- লেখক: মোবারক হোসাইন সাঈদ,
অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, কক্সবাজার।