চট্রগ্রাম প্রতিনিধি:
জাতীয় সংসদে উত্থাপিত অত্যাবশ্যকীয় জরুরী পরিষেবা বিল বাতিল, বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফদের মাইলেজ ভাতা বন্ধের প্রতিবাদ ও রেলওয়ে ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ বিধি -২০২০ সংশোধন, নির্মাণ শ্রমিকদের কাজের সময় জীবনের নিরাপত্তা, শীপ ব্রেকিং শিল্প শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি ১৬০০০ টাকা বাস্তবায়ন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৩০০০ টাকা ঘোষণা, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ সংশোধন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসরণ করে গাড়ি রিকুইজিশন, প্রতিটি সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়োগপত্র -পরিচয়পত্র প্রদান,শ্রম আইন বিরোধী আউট সোর্সিং নিয়োগ বন্ধ ও দ্রুততম সময়ে মজুরি বোর্ড গঠন করে দ্রব্যমূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা ঘোষণা করার দাবিতে, শনিবার সকাল ১০ টায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের হলরুমে বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশন বিএলএফ’র উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশন (বিএলএফ) চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি নুরুল আবছার তৌহিদ লিখিত বক্তব্যে বলেন, শ্রমিকরা এদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। শ্রমিকদের অধিকার হরণ করে দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। গত ৬ই এপ্রিল শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার লক্ষ্যে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিল ২০২৩ মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। বর্তমান আইনে বে-আইনী ধর্মঘটে শ্রমিকদের শাস্তির বিধান চলমান থাকলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার পায়তারা চলছে। এ আইনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দন্ডিত করার পায়তারা চলছে। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ দেওয়া শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূচনা লগ্ন থেকে রানিং স্টাফরা কর্মকালীন সময়ে মাইলেজ নামে একটি ভাতা বিগত দেড় শতাধিক বছর যাবত রেলওয়ে কোডে বর্ণিত বিধান মোতাবেক পার্ট অফ পে হিসাবে সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছেন। কিন্তু অতি সম্প্রতি তাদের প্রাপ্ত এই বিধিবদ্ধ অধিকার খর্ব করার আদেশ জারি করা হয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের মধ্যে মারাত্মক অসন্তোষ বিরাজ করছে। অন্যদিকে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই নব নিয়োগের প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। অবিলম্বে নিয়োগ বিধি ২০২০ সংশোধন করে শূন্য পদে নিয়োগ এবং প্রাপ্যক্ষেত্রে পদোন্নতি প্রদানের জোর দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশন।
পৃথিবীর সৃষ্টি হতে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ পৃথিবীকে সাজিয়ে তুলতে নির্মাণ শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। অথচ তারা বসবাস করে নোংরা কিংবা কোন বস্তিতে, না হয় রেললাইনের পাশে ঝুপড়িতে। নির্মাণ কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, নিরাপত্তাহীনতার মাঝে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করেছে। নির্মাণ শ্রমিকদের দেহভালের দায়িত্ব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের থাকলেও সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছে। নির্মাণ শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি কর্মস্থলে নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদান, নিরাপত্তা বেষ্টনী ব্যবহার করা, উচ্চস্থানে কাজের সময় নিরাপত্তা বেল্ট ব্যবহার করা, পেনশন স্কিম,রেশনিং ব্যবস্থা চালু, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, কর্মস্থলে আহত এবং নিহতদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান, নিয়োগপত্র প্রদান সহ উক্ত খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করার জোর দাবী জানিয়েছেন উপস্থিত নেতৃবৃন্দ।
জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে বাংলাদেশ বিগত তিন বছরে প্রথম স্থান ধরে রাখলেও, বর্তমানে গ্রীন ইয়ার্ড সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য ইয়ার্ডের মালিকদের বিশাল অংকের টাকা বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। মালিকের মুনাফা ও সরকারের বিপুল রাজস্ব নিশ্চিত হলেও শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে।ইয়ার্ড মালিকেরা এখন গ্রীন ইয়ার্ডের জন্য খুবই মরিয়া হয়ে উঠেছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় ১৫০ শীপব্রেকিং ইয়ার্ডের মধ্যে ৩টি ইয়ার্ড গ্রীন সার্টিফিকেট পেয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। গ্রীন সার্টিফিকেট পাওয়ার ক্ষেত্রে অবকাঠামগত উন্নয়নের নানা দিকনির্দেশনা থাকলেও সবুজায়তনের এই প্রক্রিয়ায় এই শিল্পে কর্মরত শ্রমিক বা শ্রমিক সংগঠনসমূহের কোন অংশগ্রহণ নেই।
বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আনতে যাদের অবদান অপরিসীম, দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে গার্মেন্টস শ্রমিকরা দিনরাত নিরলস ভাবে পরিশ্রম করলেও তাদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই, কথায় কথায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছাটাই করা হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে মালিক পক্ষের হুমকির মুখে পড়ছে। পদে পদে তাদের সংগঠন করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। যা দেশের শ্রম আইন ও প্রচলিত আইনের বিরোধী। কিছু কিছু গার্মেন্টস মালিক তাদের অনুগত শ্রমিক দিয়ে ট্রেড ইউনিয়নের নামে নাটক সাজিয়ে শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করছে। কর্মস্থলে বা রাস্তায় চলাচলে তাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। গার্মেন্টস শ্রমিকদের সকল প্রকার নিরাপত্তা বিধানসহ ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা ঘোষণা করার জোর দাবী জানিয়েছেন বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশন (বিএলএফ)’র সংবাদ সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ।
সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮এর ধারা ১১ এর (২) অনুযায়ী লাইসেন্সের পয়েন্ট কর্তন বাতিল, দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হলে ৩ বছর জেল ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা সংশোধন করতে হবে। প্রয়োজনে অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি, বুয়েটের দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ, একজন শ্রমিক প্রতিনিধিসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, ধারা: ১৩ অনুযায়ী চালক শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান, ধারা:৩৭ অনুযায়ী রাস্তার পাশে ১০ মিটারের মধ্যে কোন প্রকার হাট বাজার, দোকান, নির্মাণ সামগ্রী না রাখা, ধারা: ৩৯(১) অনুযায়ী বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (২০০৬ সালের ৪২ নং আইন) এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবহন চালক কন্টাক্ঠার, হেলপার গণের কর্ম ঘন্টা বিরতি কাল নির্ধারণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে নুরুল আবছার তৌহিদ লিখিত বক্তব্যে আরো বলেন, দেশে বর্তমানে প্রায় ৭ কোটি শ্রমিক রয়েছে। যাদের ৮৫ ভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। ইপিজেডসহ নতুন নতুন গড়ে ওঠা শিল্প কারখানায় আইনি বাধা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠছে না। ফলে শ্রমিকরা সংখ্যায় বাড়লেও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাজার দরের সাথে সংগতি রেখে বাঁচার মতো মজুরি নির্ধারণের কথা উঠলেই সামনে আনা হচ্ছে বিভিন্ন অজুহাত। শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের বিষয় নিয়ে চলছে দীর্ঘসূত্রীতা, শ্রমিকদের সংগঠন গড়ার ও করার স্বাধীনতাকে নানাভাবে সংকুচিত করা হচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হয় আমরা সেই পুরনো দাস প্রথাই ফিরে যাচ্ছি। অগণতান্ত্রিক ধারাগুলো বাতিল করে গণতান্ত্রিক শ্রমবান্ধব আইন প্রবর্তন করা, শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কর্মের পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রে নিহত ও আহতদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার জোর দাবী জানিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশন বিএলএফ’র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শাকিল আক্তার চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বিলস্ এর চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান এ এম নাজিম উদ্দিন,বিএফটিইউসির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি কাজী আনোয়ারুল হক, বিভাগীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রিজওয়ানুর রহমান খাঁন, চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক কে এম শহিদুল্লাহ, শ ম জামাল উদ্দিন, জাতীয়তাবাদী রেল শ্রমিক ও কর্মচারী দলের সাধারণ সম্পাদক এম আর মঞ্জু, বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক দল চট্টগ্রাম বিভাগের দপ্তর সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, বিএলএফ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল আবছার ভূঁইয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ রবিউল হক শিমুল, চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির যুগ্ম সম্পাদক হাজী আলমগীর হোসেন, সাইফুল ইসলাম শাহীন, চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চলের সভাপতি মফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সামছুল ইসলাম আরজু, জেলা মহিলা কমিটির সভাপতি গোলজার বেগম, মহানগর কমিটির সভাপতি মুক্তা শেখ মুক্তি, যুগ্ম সম্পাদক আমেনা বেগম, চট্টগ্রাম বিভাগীয় যুব কমিটির সভাপতি মো. আমির হোসেন, জেলা যুব কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি এমএ এমন ইউ হেলাল ও জেলা যুব কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ প্রমুখ।