ই-পেপার | শনিবার , ২৯শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সড়ক দুর্ঘটনায় পেট ফেটে জন্মনেয়া সেই ফাতেমার প্রথম জন্মদিন পালিত

সিএনএনবাংলা২৪ ডেস্ক:

মা-বাবার আদর-যত্ন ছাড়াই ফাতেমার এক বছর পার হয়ে গেলো। এই সময়ে মা-বাবার ভালোবাসা কেমন, তা বুঝতে পারলো না শিশুটি। রাজধানীর আজিমপুরের সরকারি ছোটমণি শিশু নিবাসে দেখতে গেলে দাদা-দাদির কোলে উঠতে ছুটে আসে। দাদাকে ‘দাদু’ আর আর দাদিকে ‘বু’ বলে কত কথা-ই বলার চেষ্টা করে।

 

বলছি গত বছরের ১৬ জুলাই ময়মনসিংহের ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় মায়ের মৃত্যুর আগমুহূর্তে জন্ম নেওয়া ফাতেমার কথা। পৃথিবীতে আসার সময়টা স্বাভাবিক ছিল না। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে মা-বাবা ও বোনকে হারিয়েছিল। সেদিন অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় ফাতেমা। রবিবার (১৬ জুলাই) এক বছর পূর্ণ হচ্ছে তার। বর্তমানে আজিমপুর ছোটমণি নিবাসে আদর-যত্নে বেড়ে উঠছে। সেখানে বিভিন্ন বয়সী ২৮ শিশুর সঙ্গে তার বাস। এক বছর হয়ে ওঠায় এখন তাকে খিচুড়ি খাওয়ানো হয়। সেইসঙ্গে ফিডারে দুধ খায়, ফলের রস দেওয়া হয়। যারা তার মাকে চিনতেন, তারা বলছেন ফাতেমার চেহারা মায়ের মতোই হয়েছে।

 

মা-বাবাকে হারিয়ে ছোটমণি নিবাসে ফাতেমার বেড়ে উঠার এসব তথ্য শনিবার (১৫ জুলাই) বিকালে জানিয়েছেন দাদা মুস্তাফিজুর রহমান বাবলু। তিনি বলেন, ‘মাসে দুই-তিন বার নাতনিকে দেখতে ছোটমণি নিবাসে যাই। প্রতিবার যাওয়ার সময় ফাতেমার দাদি, বোন জান্নাতুল ও ভাই এবাদতকে সঙ্গে নিয়ে যাই। ফাতেমা সেখানে বেড়ে উঠছে সুন্দরভাবে।’

 

সর্বশেষ গত ৭ জুলাই সবাই মিলে ফাতেমাকে দেখতে গিয়েছিলাম উল্লেখ করে মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ফাতেমা সবসময় হাসি-খুশি থাকে। তবে বাবা-মায়ের কথা এখনও বুঝতে পারে না। আমাদের আপনজন মনে করে। আমরা আদর-যত্ন করে রেখে আসি। তবে তাকে এভাবে রেখে আসতে কষ্ট হয় আমাদের।

 

ফাতেমার বড় বোন জান্নাতুল ফেরদৌস ও ভাই এবাদতকে গ্রামের বাড়িতে লালনপালন করছেন দাদা মোস্তাফিজুর রহমান এবং দাদি সুফিয়া খাতুন। জান্নাতুল ও এবাদত তাদের কাছে ভালো আছে।

 

জান্নাতুল ও এবাদত আমাদের কাছেই থাকে জানিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্থানীয় আনোয়ারা কিন্ডারগার্টেনে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে জান্নাতুল। তার বয়স ১১ বছর। একই প্রতিষ্ঠানে এবাদত প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। তার বয়স ছয় বছর। মাঝেমধ্যে জান্নাতুল মা-বাবার কথা মনে করে কাঁদে। তবে এবাদত তেমন একটা মনে করতে পারে না। আদর-যত্ন করে মা-বাবার কথা তাদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি সবসময়।

 

জান্নাতুল ফেরদৌস জানায়, দিন দিন ফাতেমা বড় হয়ে উঠছে। ঢাকায় দেখতে গেলে আমার কোলে আসতে চায় না। তবে ভাই এবাদতের কোলে উঠে বসে থাকে। মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ে আমার। মাঝেমধ্যে সময় কবরের কাছে গিয়ে বসে থাকি। ছোট ভাই এবাদত মা-বাবার কথা তেমন একটা মনে করতে পারে না। দাদা-দাদি আমাদের খুব আদর-যত্ন করেন। সব চাওয়া পূরণ করেন।

 

ফাতেমার দাদি সুফিয়া খাতুন বলেন, ফাতেমার বয়স এক বছর পার হতে চলেছে। ছেলে জাহাঙ্গীর আর তার স্ত্রী রত্না এভাবে চলে যাবে—কখনও ভাবিনি। তারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়ে ফাতেমা আর দুই ভাইবোনকে আমাদের কাছে এতিম করে রেখে গেছে। দাদা-দাদি ছাড়া তিন নাতি-নাতনির আর কেউ নেই। তিন ভাইবোনকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি আমরা।

 

ত্রিশালের সেই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার কথা আজও কেউ ভোলেনি উল্লেখ করে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুস্তাফিজার রহমান বলেন, সেদিন এক পরিবারের তিন জন নিহত হওয়ার এক বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। শিশু ফাতেমা সমাজসেবা অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে আজিমপুরে ছোটমণি নিবাসে আদর-যত্নে বেড়ে উঠছে। সড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতার অর্থ যৌথ হিসাবে ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে তিন শিশুর লেখাপড়াসহ যাবতীয় খরচ চালানোর জন্য। তারা যেন মানুষের মতো মানুষ হয়, সে বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোঁজখবর রাখছি আমরা।

 

গত বছরের ১৬ জুলাই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পারাপারের সময় ট্রাকচাপায় জাহাঙ্গীর আলম (৪২), তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না বেগম (৩২) ও তাদের ছয় বছরের মেয়ে সানজিদা নিহত হন। এ সময় ট্রাকচাপায় অন্তঃসত্ত্বা রত্নার মৃত্যুর আগমুহূর্তে পেট ফেটে এক মেয়েসন্তানের জন্ম হয়। উপজেলার কোর্ট ভবন এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছিল। পরে শিশুটির নাম রাখা হয় ফাতেমা। তাকে সমাজসেবা অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে আজিমপুরের ছোটমণি নিবাসে রাখা হয়েছে। তাদের বাড়ি ত্রিশাল উপজেলার রায়মনি এলাকায়। সেদিন মেয়ে সানজিদার চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছিলেন বাবা-মা। ফেরার পথে ঘটেছিল দুর্ঘটনা। মর্মান্তিক এই ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল। পরিবারটিকে আর্থিক সাহায্য দিতে এগিয়ে আসেন অনেকে। সূত্র: বাংলাট্রিবিউন

 

মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিভিন্ন জনের সহযোগিতা এবং বিআরটিএ ট্রাস্ট কর্তৃক আর্থিক সহায়তাসহ ব্যাংকে ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা আছে। এই টাকা থেকে জান্নাতুল ও এবাদতের ভরণপোষণসহ যাবতীয় খরচ চালানো হয়। প্রতি মাসে খরচের টাকা তোলার জন্য ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর আবেদন করলে তিনি অনুমোদন দিলে চেক নিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করি। ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে ঘর করার জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়েছিল। এ ছাড়া আর কোনও সহযোগিতা পাইনি।

ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জুয়েল আহমেদ বলেন, ঘটনার পর মানুষের আর্থিক সহায়তায় সোনালী ব্যাংকে একটি যৌথ হিসাব খোলা হয়েছিল। সেই টাকা থেকে প্রতিমাসে কিছু জান্নাতুল ও এবাদতের ভরণপোষণ বাবদ দাদার কাছে দেওয়া হয়। তাদের জন্য ঘর করতে ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

 

নুর মোহাম্মদ, সিএনএনবাংলা২৪: