বিশেষ প্রতিবেদক :
ভারত মহাসাগরে চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিং লিমিটেডের কয়লাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের জিম্মি করার ঘটনায় সোমালিয়ান জলদস্যুদের ভয়ঙ্কর রূপ সামনে এলেও পিছিয়ে নেই বাংলাদেশি জলদস্যুরাও।
চট্টগ্রামের কক্সবাজার থেকে খুলনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জলসীমায়ও রয়েছে জলদস্যুর দাপট। এই জলসীমায় প্রতিনিয়ত দেশি-বিদেশি পণ্যবাহী জাহাজ, এমনকি মাছ ধরার ট্রলারেও জলদস্যুর খুন, গুম, অপহরণ, চুরি ও ডাকাতির মতো ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটছে। চলতি মার্চ মাসে এখন পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে তিনটি জলদস্যুর হানার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া গত দুই মাসে ঘটেছে দুটি জলদস্যুর আক্রমণের ঘটনা। এর আগে গত বছর ১৬টি জলদস্যুর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি জলদস্যু আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে মাছ ধরার ট্রলারের জেলেদের উপর। যাদের গুম, খুন, অপহরণের মাধ্যমে বড় অঙ্কের মুক্তিপণও আদায় করেছে জলদস্যুরা।
ভুক্তভোগীদের মতে, বঙ্গোপসাগরের জলদস্যু নিয়ন্ত্রণে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে কুতুবদিয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে মিরসরাই, ফেনী, নোয়াখালী, বরিশাল থেকে খুলনা পর্যন্ত অন্তত ৩০টিরও বেশি থানার পুলিশ, কোস্টগার্ড ও র্যাবের তৎপরতা রয়েছে। অথচ বঙ্গোপসাগরে তৎপর তিন হাজারের মতো জলদস্যুকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবে র্যাবের প্রচেষ্টায় গত এক দশকে চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও সুন্দরবন অঞ্চলে অর্ধ সহস্রাধিক জলদস্যু আত্মসমর্পণ করে। এরপর সাগরে জলদস্যুর তৎপরতা কিছুটা কমলেও গত বছরের শুরু থেকে তা আবার বেড়ে যায়।
সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ বুধবার দুপুর আড়াইটার সময় সন্দ্বীপের দীর্ঘাপাড় থেকে উড়িরচর প্রান্তে আসার পথে ট্রলার ডাকাতির ঘটনা ঘটে। বামনী নদীর মাঝপথে স্পিডবোটে আসা সাত-আটজনের একটি দল সোমালিয়ান জলদস্যুদের মতো আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যাত্রীবাহী ট্রলারে থাকা যাত্রীদের জিম্মি করে ফেলে। এ সময় দলটি তাদের কাছ থেকে টাকা, স্বর্ণালংকার, মুঠোফোনসহ মালামাল ছিনিয়ে নেয়। যাত্রীদের মধ্যে কোনো একজনের মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ঘটনার এই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় সন্দ্বীপ থানায় মামলা হয়েছে। এর আগে গত ১১ মার্চ বঙ্গোপসাগরে সিরিয়ান পতাকাবাহী জাহাজের পেইন্ট স্টোরের তালা ভেঙে অন্তত ৬৫ ড্রাম রং লুট করেছে জলদস্যুরা। এদিন সকালে লুট হওয়া রং উদ্ধারে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর সহযোগিতা চেয়ে ই-মেইলে পত্র পাঠিয়েছেন জাহাজটির মাস্টার (ক্যাপ্টেন) ইয়াহিয়া কাদ্দুরাহ।
তিনি জানান, ইউরিয়া সার খালাসের জন্য এমভি বোস ব্রুক নামের জাহাজটি ২৬ ফেব্রুয়ারি মোংলা বন্দরে প্রবেশ করে। সার খালাস শেষে ৫ মার্চ জাহাজটি বন্দর ত্যাগ করে বঙ্গোপসাগরের ১২ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান নেয়। সেখানে অবস্থানকালে ১১ মার্চ ভোর রাতে নাবিকরা জাহাজটির চার পাশে প্রচুর মাছ ধরার নৌকা দেখতে পায়। কিন্তু সকালের দিকে একদল জলদস্যু জাহাজে উঠে দখল নিয়ে পেইন্ট স্টোরের তালা ভেঙে ৬৫টির বেশি রংয়ের ড্রাম লুট করে নিয়ে যায়।
জাহাজটি স্থানীয় শিপিং এজেন্ট সোর লাইনের খুলনার ম্যানেজার আবু বকর বলেন, জাহাজটি সাগরের বহির্নোঙরে অবস্থানকালে লুটের ঘটনা ঘটেছে। এটি যেহেতু বন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা নয়, সে কারণে বন্দরের কিছু করণীয় ছিল না। তারপরও মোংলা বন্দরের সুনাম রক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করে তাদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ৬ মার্চ বুধবার চট্টগ্রাম থেকে সিমেন্টের ক্লিংকার লোড করে এমভি আকিজ লজিস্টিক-২৩ নামে একটি জাহাজ কুতুবদিয়া বাতিঘরের প্রায় চার কিলোমিটার পশ্চিমে নোঙর করে। পরদিন রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে বড় একটি ফিশিং ট্রলারে করে দেশীয় তৈরি অস্ত্র নিয়ে জাহাজে উঠে মুখোশধারী ২৫-৩০ জনের সংঘবদ্ধ জলদস্যুর দল। এ সময় জাহাজের মাস্টারসহ ১২ জন কর্মচারীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মারধর করা হয়। এরপর নাবিকদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, নগদ টাকা, ব্যাটারি, ইঞ্জিন-রাডার-ইকোসাউন্ডের মনিটর, জিপিএস, সোলার প্যানেলসহ প্রায় ১০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় ১২ মার্চ মঙ্গলবার আকিজ শিপিং লাইন লিমিটেডের অপারেশন বিভাগের সিনিয়র অফিসার মো. আরিফুল ইসলাম বাদী হয়ে কোম্পানির পক্ষে কুতুবদিয়া থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এতে অজ্ঞাত ২৫-৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানান কুতুবদিয়া থানার ওসি মো. গোলাম কবির। তিনি জানান, সাগরে ওই ঘটনায় কুতুবদিয়ার কোনো জলদস্যু জড়িত কিনা সে বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গোপসাগরের চট্টগ্রাম অঞ্চলে মাছ ধরার ট্রলারে গণডাকাতির সময় ৩০ জলদস্যুকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা হয় দুটি ট্রলার।
এর আগে গত ৭ জানুয়ারি বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার অংশে ফিশিং বোটে থাকা জেলেদের মারধর করে মাছ, জাল, বিভিন্ন মালামালসহ সর্বস্ব লুটে নেয়। এর আগে গত বছরের ২৬ আগস্ট রাতে বঙ্গোপসাগরের হাতিয়া সন্দ্বীপ চ্যানেলের মাঝামাঝি কালিরচর এলাকায় মাছ ধরার ৯টি ট্রলারে হানা দেয় জলদস্যুরা। এ সময় জেলেদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে কোটি টাকার ইলিশ লুটে নেয়। জেলেদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়। লুটপাট শেষে ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল করে ডিজেল নিয়ে যায় জলদস্যুরা। এর আগে গত ২৮ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে ৩০-৩৫ জনের সশস্ত্র জলদস্যু দল বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে ফেরার পথে অন্তত দশটি ট্রলারের আহরিত মাছ, মূল্যবান যন্ত্রাংশ ও মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়। শেষে ট্রলারের ইঞ্জিনে ভাঙচুর চালায়। জেলেরা বাধা দিলে তাদের মারধর করা হয়।
চট্টগ্রাম নৌপুলিশ সুপার আ ফ ম নিজাম উদ্দিন বলেন, সাগরে কে জেলে, কে দস্যু চেনা মুশকিল! মাছ ধরতে গিয়ে গুম, খুন, লুট ও অপহরণসহ দস্যুদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন জেলেরা। তাদের কবল থেকে বাদ যাচ্ছে না দেশি-বিদেশি পণ্যবাহী জাহাজও। এক কথায় বলা যায় অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলসীমা।
তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে কক্সবাজারের মহেশখালী, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, ভোলা ও বরিশাল এলাকার দুর্বৃত্তরা জলদস্যুতায় জড়িত। তবে ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের পয়লা জানুয়ারি পর্যন্ত সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায় পরিচালিত অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অর্ধশত জলদস্যু নিহত হয়। এরপর একে একে ২৬ বাহিনীর ২৭৪ জন আত্মসমর্পণ করে।
এছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতেও চিহ্নিত কয়েকজন জলদস্যু সরদার কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। এ সময় বাঁশখালী ও কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় তৎপর পাঁচ শতাধিক জলদস্যু ৪৭০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও সাড়ে ২২ হাজার গুলিসহ র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপর থেকে সাগর-সুন্দরবন উপকূলজুড়ে জেলে, বাওয়ালী, মৌয়ালীদের মাঝে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু বর্তমানে দু-একটি ছোট দস্যুবাহিনী নতুন করে অপতৎপরতার চেষ্টা করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে তারা ধরাও পড়ছে।
আবার ভিন্ন কথাও বলেছেন চট্টগ্রাম মহানগরীর ফিশারিঘাট মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আমিনুল হক ওরফে বাবুল সরকার। তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বাত্মক অভিযানে শিথিলতার সুযোগে সাগরের বিভিন্ন চ্যানেলে জলদস্যুরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এতে চরম আতঙ্কে রয়েছে জীবিকার তাগিদে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা।
তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে সাগরে আশানুরূপ ইলিশ আহরণ হচ্ছে না। তার ওপর জলদস্যুদের উৎপাত পুরো মৎস্য খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কিন্তু প্রশাসন জেলেদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় যতটা উৎসাহ দেখায় সাগরে নিরাপত্তা নিশ্চিতে ততটা উদাসীনতার পরিচয় দেয়। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
জেলেদের অভিযোগ— সাগরে মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকাকালে প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে তৎপরতা প্রদর্শন করে থাকে, সাগরে জেলেদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে তারা ততধিক উদাসীনতার পরিচয় দেন। এতে অরক্ষিত সাগরে মাছ আহরণ করতে গিয়ে জেলেদের চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হচ্ছে।
মো. জাহাঙ্গীর নামে মাছ ধরা এক শ্রমিক বলেন, কিছুদিন আগেও মাছ নিয়ে কক্সবাজার উপকূলে ঢুকতেই ছোট ট্রলার নিয়ে দস্যুরা ধাওয়া করে। আমরা দস্যুদের অস্ত্রের কাছে কিছু না। এসব বিষয় বোট মালিক সমিতিকে জানালোও কিছু হয় না। কারণ ট্রলার মালিকরা ঐক্যবদ্ধ নন। তারা আমাদের জীবন নিয়ে চিন্তাও করেন না।
শুধু জাহাঙ্গীর নন, একই অবস্থা কক্সবাজার উপকূলের অন্যান্য জেলেরও। জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে চলে তাদের সাগরে মৎস্য আহরণ। এতে কেউ প্রাণ হারান, কেউ বা ভাগ্যের জোরে ফিরে আসেন। কিন্তু সাগরে গিয়ে জীবন বাঁচাতে দস্যুদের কাছে কীভাবে অসহায় হয়ে পড়েন তারও বর্ণনা দেন জেলেরা।
মহেশখালীর মোক্তার আহমদের মালিকানাধীন এফবি আল্লাহ দান ট্রলারের জেলে শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সাগরে গিয়ে মাছ শিকার করি। এখানে মাছ শিকারের সময় দেখি সব ট্রলারেই জাল আছে। দস্যুদের ট্রলার চেনার কোনো উপায়ও নেই। দস্যু যারা আছে, তারা হঠাৎ করে সন্ধ্যা বা রাতে আক্রমণ করে বসে। যা কোনোভাবেই বোঝার উপায় থাকে না।
এদিকে জেলেদের পাশাপাশি দস্যুদের কাছে জিম্মি ট্রলার মালিকরাও। ট্রলারের সবকিছু হারিয়েও উপকূলে দস্যু সিন্ডিকেটের ভয়ে যান না প্রশাসনের কাছে। আবার মোহাম্মদ আবু নামে এক ট্রলার মালিকের অভিযোগ, সব হারিয়ে কেউ কেউ প্রশাসনের কাছে গিয়েও কোনো সহযোগিতা পাননি। প্রশাসন যদি এগুলো নিয়ে তদন্ত করে, তবে অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে।
ফিশারিঘাটস্থ আড়তদার সমিতির সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ আজাদ বলেন, দস্যুদের নিরাপদ স্থান সাগর। কারণ দস্যুরা যখন সাগরে দস্যুতা করে, তখন জেলেরা বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করেন। কিন্তু পুলিশ কিংবা কোস্টগার্ড সাগরে ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই দস্যুরা লুটপাট চালিয়ে চলে যান। আর সাগরে যেখানে মাছ বেশি ধরা পড়ে সেখানে জলদস্যুদের দৌরাত্ম বেশি থাকে।
আরেক ট্রলার মালিক শফি উল্লাহ বলেন, সাগরে মাছ শিকারের সময় জলদস্যুরা ট্রলার ও মাঝিমাল্লাদের নিয়ে গেছে। এরপর মোবাইলে মুক্তিপণ দাবি করে। এসব বিষয় প্রশাসনকে জানালে পাত্তা দেয় না তারা। কারণ সাগরে ঘটনা ঘটেছে। তারা একবার বলে সোনাদিয়ায় যাও, আবার বলে মহেশখালী যাও, নয়তো পাতুয়ারটেক কিংবা উখিয়া যাও। এভাবে সময় চলে যায়, কিন্তু কোনো সুরাহা পায় না।
জেলা ফিশিং বোট মালিকরা জানিয়েছে, গত ৫ বছরের বঙ্গোপসাগরে কক্সবাজারের কমপক্ষে ২০ জেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছেন শতশত জেলে। লুট হয়েছে কয়েক হাজার ট্রলার। এর আগে বঙ্গোপসাগরে ২০১০ সালে কক্সবাজারের খুরুশকুলের ১৭ জেলে ও পেকুয়ার ১৪ জেলের মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল। তারপর ২০১৩ সালে হাত-পা বাধা অবস্থায় তিনটি ট্রলারের ৩৪ জেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আর গত বছর ২৩ এপ্রিল ট্রলারের হিমঘর থেকে উদ্ধার হয় ১০ জনের মরদেহ।
বিশ্বে দস্যুতা পর্যবেক্ষণকারী দুটি সংস্থা জাহাজে চুরি-ডাকাতির ঘটনা রেকর্ড করে থাকে। একটি হল দ্য রিজিওনাল কো-অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট অন কমব্যাটিং পাইরেসি অ্যান্ড আর্মড রবারি অ্যাগেইনেস্ট শিপস ইন এশিয়া বা রিক্যাপ এবং আরেকটি ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো বা আইএমবি।
সংস্থা দুটির বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি চুরি-ডাকাতির ঘটনা বা ঘটনার চেষ্টা হয়েছে ২০১৪ সালে। ওই বছর জাহাজে ১৬টি চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ ও ২০২১ সালে কোনো ঘটনা ঘটেনি। ২০২২ সালে বাংলাদেশের জলসীমায় পাঁচটি ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে চট্টগ্রামে তিনটি ঘটনা ঘটেছে।
বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙরে অবস্থানরত ৯টি জাহাজে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ থেকে শিপিং এজেন্টদের কাছে পাঠানো চিঠিতে চুরি-ডাকাতির এই ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।
অপরদিকে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) ২০০৬ সালের একটি প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বন্দরকে জলদস্যু আক্রমণের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক বন্দর ঘোষণা করা হয়। ওই বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছিল ৪৭টি। একের পর এক দস্যুতার ঘটনায় ওই সময়ে পৃথিবীজুড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নেতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে অনিরাপদ মনে করে বিদেশি জাহাজগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে অস্বীকৃতি জানাত। আর যেসব জাহাজ পণ্য নিয়ে বন্দর জলসীমায় পৌঁছাত, তারাও সারচার্জ বা বাড়তি মাসুল আরোপ করত। ফলে পণ্য আমদানি ও রফতানিতে খরচ বেশি লাগত।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (নিরাপত্তা) মোস্তফা আরিফুর রহমান খান বলেন, বন্দরে জাহাজের সংখ্যা নিয়মিত বাড়ছে। নিরাপত্তার স্বার্থে জাহাজে পাহারাদার নিয়োগ দেওয়া দরকার। এ জন্যই শিপিং এজেন্টদের বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে শিপিং এজেন্টের নেতারা বলছেন, বন্দরের বেতার নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বা ভিটিএমআইএসের মাধ্যমে সচিত্র তদারক করা হয়। আবার জেটিতে রয়েছে নানা স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। এ রকম কড়া নজরদারির মধ্যেও জাহাজে চুরি-ডাকাতির ঘটনা কারা ঘটায় তা খতিয়ে দেখা দরকার।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) নুরুল আবছার বলেন, বঙ্গোপসাগরে অন্তত দুই শতাধিক জলদস্যু গ্রুপ রয়েছে। যাদের সংখ্যা তিন হাজারের মতো। সাগরের দুর্গম উপকূলে গা ঢাকা দিয়ে তারা আক্রমণ চালায়। মাছ ধরার ট্রলার থেকে দেশি-বিদেশি পণ্যবাহী জাহাজ তাদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে।
কোস্ট গার্ড পূর্বাঞ্চলের জোনাল কমান্ডার মো. জহিরুল হক বলেন, সাগরে দস্যুতার অভিযোগগুলোর তদন্ত চলছে। কোস্ট গার্ডের সদস্যরা সাগরে জেলেসহ সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিয়মিত টহলের পাশাপাশি সব ধরনের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। আশা করি স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হবে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরে আলম মিনা বলেন, বঙ্গোপসাগরের মতো বিশাল জলরাশিতে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট ও সক্ষমতা এখনও পরিপূর্ণ নয়। যে কারণে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে জলদস্যুদের অপতৎপরতা রুখে দিতে আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। সাগরে আমাদের জলসীমা নিরাপদ রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর।
তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি; কিন্তু গভীর সাগরে তো! কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে গিয়ে টহল দেওয়া যায় না। তারপরও যারা জলদস্যুতার সঙ্গে জড়িত বা সাগরে যারা অপরাধ করে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছি।