ই-পেপার | শুক্রবার , ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নামেই শুধু ‘ভিক্ষুকমুক্ত খুলনা’

নিজস্ব প্রতিবেদক

খুলনা: ২০১৭ সালের ৮ মে খুলনাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু ভিক্ষুকমুক্ত খুলনা এখন শুধু নামেই।

প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরে চোখে পড়ে ভিক্ষুকের ছড়াছড়ি। অলিতে গলিতে ভিক্ষুকের দেখা মেলে।

হাসপাতাল, মসজিদ, করবস্থান, বিভিন্ন হোটেলের সামনে, রেস্তোরাঁ, বাস টার্মিনাল, রাস্তাঘাটে, মার্কেটেসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে সর্বত্র দেখা মেলে ভিক্ষুকের। ভিক্ষুকমুক্ত খুলনা এখন ভিক্ষুকের নগরীরে পরিণত।

অনেক সময় সামর্থ্যহীনেরা ভিক্ষুকদের সাহায্য করতে না পেরে অস্বস্তি ও বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন।

অভিযোগ রয়েছে, কেউ কেউ হয়তো ক্ষুধার তাড়নায় অনন্যোপায় হয়ে ভিক্ষা করছেন। কিন্তু অধিকাংশই ভিক্ষাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

পবিত্র শবে বরাত ও রমজানকে সামনে রেখে দেশের সবখানের ভিক্ষুকদের ভিড় বাড়ে। কারণ, শবে বরাতের সৌভাগ্যকে উপলক্ষ করে অনেকে হাত খুলে দান-সদকা করেন।

ঠিক এ সুযোগটিকে কাজে লাগাতে খুলনায় বেড়ে গেছে মৌসুমী ভিক্ষুকের সংখ্যা।

রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই নগরীর খানজাহান আলী রোডের টুটপাড়া কবরস্থান, বসুপাড়া কবরস্থান ও গোয়ালখালী করবস্থানের সামনে হাজার হাজার ভিক্ষুকের জটলা। ভিক্ষুকদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের নিয়োজিত ব্যক্তিরা।

মুসল্লিদের থেকে সহায়তা পাওয়ার আশায় নগরীর বোয়ালখালী কবরস্থানের সামনে বসে ভিক্ষুকেরা

ভিক্ষুকরা বলেন, শবে বরাত উপলক্ষে ভিক্ষা করতে এসেছেন তারা। কবরস্থানে স্বজনদের কবর জিয়ারত করে যাওয়ার সময় দান করছেন মানুষ। তাদের সে দান পাওয়ার আশায় ভিক্ষুকদের এ জটলা।

টুটপাড়া কবরস্থানের সামনে ভিক্ষা করার সময় কথা হয় তেরখাদার আজগড়া গ্রামের আমজাদ মুন্সীর সঙ্গে। তার হাতে অনেক প্রেসক্রিপশন। তিনি জানান, তার কিডনি ও হার্টের সমস্যা। যে কারণে ভিক্ষা করেন। সরকারের কোন সহযোগিতা বিগত দিনে পাননি তিনি।

জহুরা নামের এক বৃদ্ধা ভিক্ষুক জানান, তার বাড়ি বটিয়াঘাটা উপজেলার হোগলাডাঙ্গা গ্রামে। ছেলেমেয়ে নেই। সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পের কোনো সুযোগ-সুবিধা তিনি পাননি।

অনেকে রমজান মাসে যাকাত-ফিতরা ও ঈদ উপলক্ষে দান-খয়রাত সংগ্রহে আগেভাগে শহরে এসে অবস্থান নিচ্ছেন।

 

খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১ আগস্ট থেকে প্রথমবারের মতো খুলনা বিভাগকে ভিক্ষুকমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

খুলনা মহানগরসহ জেলার নয়টি উপজেলায় তখন ৩ হাজার ৫৯৫ জন ভিক্ষুকের নাম নিবন্ধন করা হয়। এরপর তিনটি ধাপে তাদেরকে প্রায় ৪০ লাখ টাকার পুনর্বাসন সামগ্রী দেওয়া হয়।

ভিক্ষুকদেরকে পুনর্বাসনের জন্য সেলাই মেশিন, ভ্যান-রিকশা, হাঁস-মুরগি, মুদি দোকান, পুরাতন কাপড় বিক্রি, কাঁ ডিম বিক্রি, চামালের ব্যবসা, পিঠা তৈরি, ওজন মাপা মেশিন, ঝাল-মুড়ি ও চানাচুর বিক্রি, আগরবাতি তৈরির মালামাল, টক দই বিক্রি, ঠোঙা বিক্রি, হাড়ি-পাতিল বিক্রি, শাক-সবজি বিক্রির ভ্যান গাড়ি, চা এর দোকানের উপকরণসহ ১৪ প্রকার উপকরণ সামগ্রী দেওয়া হয়েছিল।

এরপর ২০১৭ সালের ৮ মে খুলনাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন।

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ভিক্ষুক মুক্ত খুলনা যেন এখন ভিক্ষুকের নগরী। শহরের সড়ক ও অলিগলির মোড়ে, কাঁচাবাজার, চায়ের দোকান, বিপণি বিতান, ট্রাফিক সিগন্যাল, মসজিদ, বাস, ট্রেন, লঞ্চ টার্মিনাল, এটিএম বুথ, আদালত পাড়া, হাসপাতাল, শপিং মলের সামনে দিন এবং রাতে হাজারো ভিক্ষুকের দেখা মেলে। দিন যত যাচ্ছে শহরে বাড়ছে ভিক্ষুকদের সংখ্যা। ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্র ও প্রশাসনকেই উদ্যোগ নিতে হবে। কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করলে ভিক্ষাবৃত্তি মুক্ত করা সম্ভব। ভিক্ষার মূল কারণ হলো দারিদ্র, তাই প্রথমে দারিদ্র দূর করা তথা দারিদ্র সীমার নিচে বাস করা লোকদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সবার জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে ভিক্ষুকদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফিন বলেন, ভিক্ষুক পূনর্বাসন প্রক্রিয়া এখনও চলমান আছে। অনেকেই সুবিধা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। তবে কেউ কেউ আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। তারপরও ভিক্ষুকদের পূনর্বাসন প্রক্রিয়ায় এনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।