ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নির্বাচনে যিনিই জিতুন আসলে জিতবেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

 

আজ ১৬তম জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে পাকিস্তানে। নির্বাচন ঘিরে গত কয়েক দিন ধরে জল্পনাকল্পনার শেষ ছিল না। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে কে জিততে পারে—এই আলোচনা ছাপিয়ে সবার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। তাকে নিয়ে আলোচনা ঘুরপাক খাওয়ার কারণ, অনেকে মনে করছেন, ক্ষমতা সুসংহতের চেষ্টা করছেন তিনি। এ রকম পটভূমিতে নির্বাচনের পর নতুন সরকারে মুনির কাকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসাবেন, তা নিয়ে যতটা না কথা হচ্ছে, তার চেয়ে ঢের বেশি আলোচনা চলছে খোদ মুনিরকে নিয়ে। আলোচনা হওয়ারই কথা। এর কারণ, মুনির নিজেকে সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছেন বলতে হয়। তুমুল জনপ্রিয় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে মাঠের বাইরে রাখার জন্য হেন কাজ নেই, যা তিনি করেননি। শুধু এতটুকুই নয়, রাজনীতির মাঠ ঢেলে সাজাতে যা যা করা দরকার, তার সবই করেছেন তিনি। এমনকি অর্থনৈতিক চাপ সামলানোর প্রশ্নে নানামুখী সংস্কারের পথ ধরতেও দেখা গেছে তাকে। এসব দেখে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, ‘পাক্কা খেলোয়াড়’ মুনির থামার পাত্র নন! ২০২৫ সালের শেষের দিকে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি সূর্যাস্তের পথ ধরবেন কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

 

মুনির একা যে এমন করছেন, তা কিন্তু নয়। বরং বলতে হয়, তিনি পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধানদের পথ অনুসরণ করছেন মাত্র। এমন কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, পাকিস্তানের আগামী দিনের ভাগ্য যার হাতে, তিনি হচ্ছেন ‘সেনাপ্রধান আসিম মুনির’।

 

মুনির তার পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে ‘পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ানো’ বেসামরিক রাজনৈতিক নেতাদের শায়েস্তা করছেন বটে, কিন্তু এ কাজ যে তিনি খুব নির্বিঘ্নে করতে পারছেন, তেমনটাও নয়। নানাবিধ সংকটে জর্জরিত পাকিস্তানের হাল দরে রাখা একদিকে তার জন্য যেমন ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে ‘এই অঞ্চলে ইসলামাবাদের ক্রমে গুটিয়ে পড়া ভাব’ তার সামনে নতুন নতুন দেওয়াল তুলে দিচ্ছে। এসবের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে নানামুখী আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমীকরণ। সব মিলিয়ে মুনিরের চলার পথ বেশ জটিলই।

 

উল্লেখ করার বিষয়, ভারত সব সময়ই পাকিস্তানের জেনারেলদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার কথা বলে থাকে। আগেকার জেনারেলদের সঙ্গে দিল্লি তেমনটাই করতে চেষ্টা করেছে বলতে হবে। তবে নির্বাচনের আগে-পরে জেনারেল মুনিরের সঙ্গে ভারত দরকষাকষিতে গিয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী তেমন কিছু না-ও পেতে পারেন। অন্যভাবে বললে, ইসলামাবাদের ওপর দিল্লির বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা জেনারেল মুনিরের কাছে খুব একটা ‘গ্রহণযোগ্যতা’ পাবে বলে মনে হয় না। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, দিল্লি দৃঢ়ভাবে মনে করে—যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, পাকিস্তান-ভারত হিসাবনিকাশে তেমন কোনো নড়চড় হয় না। এমনকি ভারত এ-ও বিশ্বাস করে, পাকিস্তানের জেনারেলরা দুই দিকেই খেলতে জানেন! একদিকে তারা পাকিস্তানকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখেন; অন্যদিকে বাইরের গোলমালে সময় দেওয়ার মতো ফুরসতও বের করতে জানেন। ভারতের এমন ধ্যানধারণার মুখে আগামী দিনগুলোতে মুনির কতটা নিজেকে প্রমাণ করতে পারেন, তা-ই দেখার বিষয়। যদিও ‘বর্তমান পাকিস্তান’ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি উত্তপ্ত।

 

মুনির যে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা একপ্রকার নিশ্চিত। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ২০২২ সালের নভেম্বরে অনেকটা হুট করে সেনাপ্রধান হন তিনি। তত্কালীন সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার গুঞ্জন উঠলেও তা ভেস্তে যায়। এরপর মুনির কেবল নিজের ‘আসন’ শক্ত করার কাজই করে গেছেন এবং এর জন্য যা যা দরকার, তার সবই করেছেন।

 

ইমরান খানকে ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিকভাবে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছেন মুনির—এমন কথা প্রায় সবার মুখে মুখে। পাকিস্তানে খুব কম রাজনৈতিক নেতা পাওয়া যাবে, যারা সেনাবাহিনীর আধিপত্য মানতে চাননি। এক্ষেত্রে ইমরান ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রধানমন্ত্রী থাকার একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাহাসে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এতে মুনির চটে যান স্বভাবতই। ফলে ইমরান খানকে শেষ করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন মুনির। বুশরা বিবির সঙ্গে ইমরানের বিয়েকে অবৈধ ঘোষণা কিংবা বুশরাকে শাস্তি দেওয়াসহ ইমরানকে রাজনৈতিক হেয়প্রতিপন্ন করতে চেষ্টার খামতি রাখেননি তিনি। বলা যায়, ‘বুশরা-ইমরান ইস্যু’ ছিল ইমরানের ‘রাজনৈতিক বেলুন পাংচার’ করার সবশেষ হাতিয়ার। ক্রিকেটার বা প্লেবয় থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও ধার্মিক ইসলামি নেতা হয়ে ওঠা ইমরানকে আটকাতে মুনিরের ছুড়ে দেওয়া এক একটা ইস্যুর মুখে ইমরানকে কেবল অসহায়ত্বই বরণ করতে দেখা গেছে।

 

ফিরে যাওয়া যাক ২০১৮ সালে। রাজনীতির ময়দানে দাঁড়িয়ে ইমরান দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন ‘রিয়াসত-ই-মদিনা’, যার অর্থ ‘একটি ন্যায়সংগত কল্যাণ রাষ্ট্র’। ইমরান যে এই মিশন বাস্তবায়নের পথে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তার সাক্ষী গোটা বিশ্ব। আজ পাকিস্তানে কিংবা বিদেশের মাটিতে বসে ইমরানের যেসব বন্ধু বা সমর্থক তার পক্ষে কথা বলেন, সেদিকে দৃষ্টি দিলেই এর প্রমাণ মিলবে। সবার মুখেই যেন এক রা—ইমরান ‘একা খেলে গেছেন এবং যাচ্ছেন নেকড়ের মতো’।

 

ইমরান যে সেনাবাহিনীকে কখনোই পাত্তা দেননি, তাদের ঘেঁষ নেননি, তা কিন্তু নয়। বরং যে সেনাবাহিনীর রোষানলে ইমরান সর্বস্বান্ত হয়েছেন, সেই বাহিনীর ঘাড়ে চড়েই তার উত্থান। উপরন্তু বলতে হয়, ক্ষমতায় আসতে ও ক্ষমতার মসনদে বসে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের লাগাতার ঘায়েল করার কাজটি বেশ ভালোমতোই করেছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধ্বংস করে তিনি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলেন। থেমে থাকেননি এতটুকুতেই। ঐতিহ্যবাহী বন্ধু রাষ্ট্রগুলো থেকে পাকিস্তানকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। ওয়াশিংটন তাকে উত্খাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত—এমন অভিযোগ শোনা গেছে খোদ তার মুখ থেকেই! কাবুলে তালেবানের প্রত্যাবর্তন উদ্যাপন তো করেছেনই, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে মস্কোয় উড়ে যান পর্যন্ত! ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে জোট করে ইসলামি বিশ্বে সৌদি নেতৃত্বকে দুর্বল করতে চেয়েছিলেন ইমরান। আরো গুরুতর বিষয়, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর নিয়ে অস্বস্তিকর সব প্রশ্ন তুলে বেইজিংকেও বিচ্ছিন্ন করে তোলেন পাকিস্তনের আলোচিত-সমালোচিত এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

 

সমালোচকেরা বলতে চাইবেন, ইমরান খানের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। কারণ, সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার স্বার্থ ছিল পরিপূরকের মতো। দাবি উঠতে পারে, ইমরানের যতটা সেনাবাহিনীর সহায়তা দরকার ছিল, ঠিক ততটাই সেনাবাহিনীর তাকে প্রয়োজন ছিল। ইমরান-সমর্থকেরা এমনও মনে করে থাকতে পারেন, ‘খেলা এখনো শেষ হয়নি। ইমরানকে সব দিক থেকে বেঁধে ফেলতে যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা।’ এক্ষেত্রে একটা যুক্তিই যথেষ্ট—ঐ সব সমর্থক কি ইমরানকে আবারও ক্ষমতায় আনতে তার দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন দেবেন? জেনারেল মুনিরের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে দলে দলে ভোট দিতে যাবেন? তেমনটা ঘটার সম্ভাবনা কম। দিন শেষে আমরা হয়তো ইমরান অধ্যায়ের অবসানই দেখতে পাব—অন্তত এবারের নির্বাচনে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নিজের পছন্দের প্রধানমন্ত্রীকেই বেছে নেবেন জেনারেল মুনির।

 

মুনিরের সমস্যা শুরু হবে মূলত এখান থেকেই! অনেকের জানা, ইমরান এক হিসাব কষে জনগণকে দেখিয়েছেন যে, সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পাকিস্তানের জন্য সেনাবাহিনীকে আর শীর্ষ আসনে রাখা ঠিক হবে না। জনগণ ইমরানের কথা কানে তোলেনি বলে যেহেতু শোনা যায়নি, তাই ধরে নেওয়া যায়, মুনিরের সামনের পথ বেশ চ্যালেঞ্জিং। একটা বিষয় খেয়াল করা দরকার, মুনির নিজেকে ‘অর্থনৈতিক সংস্কারে চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছেন, কিন্তু তা কেউ কর্ণপাত করছে না, এমনকি রাজনীতিবিদেরাও নন। নিজের মতো করে সংস্কারের পথে হাঁটলে বাস্তবিক অর্থে তা কতটা আলোর মুখ দেখবে, সেই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে। ফলে অর্থনৈতিক সংস্কারের অন্যতম দিশারি হিসেবে মুনির যতই নিজের সাফাই গান না কেন, তা রাজনৈতিক মহল কিংবা সর্বসাধারণের সেভাবে দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পারেনি বা পারবে না।

 

ভুলে গেলে চলবে না, বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় একধরনের অস্থিতিশীলতা চলছে। ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ রয়েছে পশ্চিম সীমান্তেও। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এসব ঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারছে না বলে গুঞ্জন রয়েছে দেশের মধ্যে। পশতু উপজাতীয় এলাকায় তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) জঙ্গিবাদের পুনরুত্থান কিংবা কাবুলে তালেবান সরকারের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সমস্যাও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে সেনাবাহিনীর প্রতি। সর্বোপরি, বৈশ্বিক রাজনীতি থেকে পাকিস্তানের ক্রমশ ছিটকে পড়া ঠেকাতে পারা মুনির কেন, যে কারো জন্যই অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে।

 

দুই দশক আগে পাকিস্তানের তত্কালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফ ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বিশ্ব জুড়ে রীতিমতো নন্দিত হয়েছিলেন। ন্যাটোর বাহবা কুড়ানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবানও হয়েছিলেন। ইসলামাবাদ হয়ে উঠেছিল বেইজিংয়ের সর্বকালের সেরা অংশীদার। সেই সব আজ শুধুই ইতিহাস। জেনারেল মুনিরের সম্ভবত সে ধরনের বিলাসিতা করার সুযোগ থাকবে না আগামী দিনগুলোতে।

 

লেখক: সিংগাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের প্রফেসর ও দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কনট্রিবিউটিং এডিটর

দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনুবাদ: সুমৃত্ খান সুজন