ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চোঙ্গা পিঠার উপকরণ ঢলুবাঁশ বিলুপ্তির পথে

সালেহ আহমদ স’লিপক :
মৌলভীবাজার ও সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্য পিঠে-পুলির অন্যতম চোঙ্গা পিঠা বিলুপ্তির পথে। আগের মতো এখন আর গ্রামীণ এলাকার বাড়িতে বাড়িতে চোঙ্গা পিঠার আয়োজন চোখে পড়ে না। শীতের রাতে খড়কুটো জ্বালিয়ে সারারাত চোঙ্গাপুড়ার দৃশ্যও তাই দেখা যায় না। এক সময় ছিলো বাজার থেকে মাছ কিনে কিংবা হাওর-নদীর হতে বড় বড় রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, পাবদা, কই, মাগুর মাছ ধরে নিয়ে এসে হাল্কা মসলা দিয়ে ভেজে (আঞ্চলিক ভাষায় মাছ বিরান) দিয়ে চোঙ্গা পিঠা খাওয়া ছিলো মৌলভীবাজার তথা সিলেট অঞ্চলের একটি অন্যতম ঐতিহ্য।
বাড়িতে মেহমান বা নতুন জামাইকে শেষ পাতে চোঙ্গা পিঠা মাছ বিরান আর নারিকেলের পিঠা বা রিসা পরিবেশন না করলে যেনো লজ্জায় মাথা কাটা যেতো।
বর্তমানে সেই দিন আর নেই। চোঙ্গা পিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ ঢলু বাঁশ ও বিন্নি ধানের চাল (বিরইন ধানের চাল) সরবরাহ এখন অনেক কমে গেছে।
অনেক স্থানে এখন আর আগের মতো চাষাবাদও হয় না।
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাথরিয়া পাহাড়, জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা, রাজনগর উপজেলা সহ বিভিন্ন উপজেলার টিলায় টিলায় ও চা-বাগানের টিলায়, কুলাউড়া উপজেলার গাজীপুরের পাহাড় ও জুড়ী উপজেলার চোঙ্গাবাড়ীতে প্রচুর ঢলুবাঁশ পাওয়া যেতো। তন্মধ্যে চোঙ্গাবাড়ীও এক সময় প্রসিদ্ধ ছিলো ঢলুবাঁশের জন্যে। অনেক আগেই বনদস্যু ও ভুমিদস্যু এবং পাহারখেকোদের কারণে বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়ায় হাঁরিয়ে গেছে ঢলুবাঁশ। তবে জেলার কিছু কিছু টিলায় এখনও ঢলুবাঁশ পাওয়া যায়। পাহাড়ে বাঁশ নাই বলে বাজারে ঢলুবাঁশের দামও এখন তাই বেশ চড়া। ব্যবসায়ীরা দুরবর্তী এলাকা থেকে ঢলুবাঁশ ক্রয় করে নিয়ে যান নিজ নিজ উপজেলার বাজার সমুহে বিক্রির আশায়। বাঁশটিও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া জরুরী।
ঢলুবাঁশ ছাড়া চোঙ্গাপিঠা তৈরি করা যায় না কারণ ঢলুবাঁশে এক ধরনের তৈলাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা আগুনে বাঁশের চোঙ্গাকে না পোড়াতে সাহায্য করে। ঢলুবাঁশে অত্যাধিক রস থাকায় আগুনে না পুড়ে ভিতরের পিঠা আগুনের তাপে সিদ্ধ হয়। ঢলুবাঁশের চোঙ্গা দিয়ে ভিন্ন স্বাদের পিঠা তৈরি করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো জায়গায় চোঙ্গার ভেতরে বিন্নি চাল, দুধ, চিনি, নারিকেল ও চালের গুড়া দিয়ে পিঠা তৈরি করা হয়। পিঠা তৈরি হয়ে গেলে মোমবাতির মতো চোঙ্গা থেকে পিঠা আলাদা হয়ে যায়। চোঙ্গাপিঠা পোড়াতে আবার প্রচুর পরিমানে খড় (নেরা) দরকার পড়ে। খড়ও এখন সময়ের প্রয়োজনে দাম একটু বেশি। একটা সময় ছিলো শীতের মৌসুমে গ্রামীণ জনপদে প্রায়ই বাজারে মাছের মেলা বসত, বিশেষ করে সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম উৎসব পৌষ সংক্রান্তির সময় এ বাঁশগুলো কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ, আদমপুর, মুন্সীবাজারসহ বিভিন্ন হাটবাজারে দেখা গেছে।
কমলগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ী এলাকায় প্রচুর ঢলুবাঁশ পাওয়া যেতো। তন্মধ্যে চোঙ্গাবাড়িও এক সময় প্রসিদ্ধ ছিলো ঢলুবাঁশের জন্যে। অনেক আগেই বনদস্যু ও ভুমিদস্যু এবং পাহাড়খেকোদের কারণে বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়ায় হাঁরিয়ে গেছে ঢলুবাঁশ। তবে জেলার কিছু কিছু টিলায় এখনও ঢলুবাঁশ পাওয়া যায়।
পিঠা তৈরী করার জন্য মুন্সীবাজারে ডলুবাঁশ নিতে আসা নিবাস চন্দ বলেন, আসলে সব সময় তো এই জিনিসগুলো পাওয়া যায় না। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে এগুলো খুব কম পরিমান বাজারে উঠেছে। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে প্রচুর দেখা যেতো। এখন কালের পরিবর্তনে হাঁরিয়ে বসেছে। বাজার আসার সময় পরিবারের সদস্যরা বললো পিঠা তৈরি করার জন্য এই ঢলুবাঁশ পেলে নিয়ে যেতে। তাই কয়েকটা বাজারগুলো ঘুরে দেখলাম পাইনি এখন মুন্সীবাজারে স্বল্প পরিমান নিয়ে এসেছে বিক্রেতা। আমি সেখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি বাসায়।
কমলগঞ্জ উপজেলার লেখক-গবেষক ও উন্নয়ন চিন্তক আহমদ সিরাজ জানান, আগে কম-বেশি সবার বাড়িতে ঢলু বাঁশ ছিল। এখন সেই বাঁশ আগের মতো নেই। এই বাঁশ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। একসময় এই ঢলুবাঁশ দিয়ে চুঙ্গাপুড়ার ধুম লেগেই থাকতো।