ই-পেপার | বুধবার , ৩রা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সাহিত্যের হালচাল কেউ বলছেন মহাকাল -মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী

শিল্প সাহিত্য চর্চা হচ্ছে যুগে যুগে মানব সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি। সেই আড়াই হাজার বছর আগের গ্রীক সভ্যতার যুগ থেকে এ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে। ভারতীয় সভ্যতায়,পারস্য সভ্যতায়, এরাবিয়ান সভ্যতায়, মিশরীয় সভ্যতায়, চীন সভ্যতায়, রুশ সভ্যতায় শিল্প সাহিত্য প্রেমী মানুষেরা লেখালেখি আঁকাআঁকি করে করেই শিল্প সাহিত্যের বিকাশ ঘটিয়েছে।

যার বিস্তারিত বিবরণ লিখতে গেলে কয়েক শ পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা সম্ভব হবে না। আমরা আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করে সাধারণত তিনটি যুগের কথা উল্লেখ করে থাকি। যথা (১) প্রাচীন যুগ (২) মধ্য যুগ (৩) আধুনিক যুগ।

(১) প্রাচীন যুগের সময়কাল রাজা শশাঙ্কের শাসনামল থেকে পাল রাজা ও সেন রাজাদের শাসনামল দীর্ঘ ছয় শত থেকে সাত শত বছর পর্যন্ত। সেই প্রাচীনকালের ইতিহাস ঐতিহ্য বলতে আমাদের শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক উদ্ধারকৃত একখন্ড পুস্তিকা “চর্যাপদ” ব্যতীত আর কিছু আমাদের হাতে নেই। কালের আবর্তে হয়তো বা কেউ জ্বালানি পুঁড়িয়ে ভস্ম করে দিয়েছে। নয়তো বা জলোচ্ছ্বাসে বন্যায় প্লাবিত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে বিভিন্ন প্রস্তরখন্ডের মধ্যে কিছু কিছু লেখা এখনো স্মৃতি গাঁথা হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে।

(২) মধ্য যুগের কবি শাহ্ মুহাম্মদ সগীর ছিলেন গৌড়ের স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের রাজ দরবারের রাজ কবি। সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি রচনা করেছিলেন ইউসুফ জুলেখা মহাকাব্য। যার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ইরানের মহাকবি হাফিজ শিরাজীকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

মধ্য যুগের কবি লেখকদের মধ্যে রয়েছেন কবি গরীব উল্লা শাহ, বিদ্যাপতি, কবি কঙ্কন, মহাকবি আলাওল, আবদুল হাকিম, সৈয়দ সুলতান প্রমুখ। যাদের লেখা বই পুস্তক বেশির ভাগ-ই উদ্ধার করেছিলেন চট্টগ্রামের গুণী মহাজন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ।

আমাদের দেশের শিক্ষা দীক্ষা শিল্প সাহিত্যচর্চা দীর্ঘদিন জিইয়ে রেখেছিলেন আমাদের পূর্ববর্তীরা ঘরে ঘরে পুথি-পত্র পাঠ করে করে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। নয়তো আমাদের ভাষা চর্চার অভাবে আমাদের বাংলাভাষা বিলীন হয়ে যেতো।

(৩) রামা রামমোহন রায়, উইলিয়াম কেরি, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, প্রমথ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দিন, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ গুণী মহাজনের অক্লান্ত সাধনায় আমাদের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল।

১৯৫২ সালে ঢাকায় বাংলাভাষার জন্য বাংলাভাষা দরদী ছাত্র-ছাত্রী ও জনতা রাজপথে জীবন দিতে এগিয়ে না আসলে এবং সালাম বরকত জবাব রফিক শফিউল প্রাণ বিসর্জন না দিলে; সেই চেতনায় ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন না করলে, আজকে হয়তো বাংলাভাষা চর্চার নামগঁন্ধ থাকতো না। আর কেউ বাংলা সাহিত্যে চর্চাও করতে সাহস পেতো না। এভাবে পৃথিবীর বুকে অনেক অনেক জাতি বিলীন হয়ে গেছে। সেই সাথে তাদের ভাষাচর্চা শিল্প সাহিত্যচর্চাও বিলীন হয়ে গেছে।

আমাদের পার্শবর্তী ভারতের আসাম বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষা চর্চার অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে ১৯৬১ সালের ১৯ মে কমলা ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১১ জন ভাষাসৈনিক প্রাণ বিসর্জন দিয়ে বাংলাভাষা চর্চার অধিকার রক্ষা করেছিলেন।

পৃথিবীর বুকে বাংলাভাষা চর্চার উপর যত ষ্টীমরোলার চালানো হয়েছে এবং মহান আল্লাহর রহমতে বাংলাভাষা বাংলা সাহিত্য এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে। যার নজির অনন্য।

আমাদের মহান স্বাধীনতার অনেক অনেক পূর্ব থেকে বিশেষ করে শেরে বাংলা, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখের প্রেরণায় উনবিংশ থেকে বিংশ শতাব্দীর পুরো ভাগ জুঁড়ে এবং বর্তমান একুশ শতকে ব্যাপকভাবে শিল্প সাহিত্য চর্চা হচ্ছে; যাহা অস্বীকার করা সম্ভব নয় কারো পক্ষে।

উপসংহারে বলতে হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের ইন্টারনেট এবং ফেইসবুক অথোরিটির বদৌলতে আমরা আমাদের শিল্প সাহিত্য চর্চা করতে পারছি অতি সহজে ঘরে বসে বসে; উদার মন মানসিকতায় যাকে শিল্প সাহিত্য চর্চার মহাপ্লাবন বললে কম হবে না।

কিন্তু এখানে কবিতা চুরি হচ্ছে, লেখা চোরাচোরি হচ্ছে সময়ে সময়ে এবং লেখা চোর ধরে তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা হচ্ছে এই আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে। যারা যারা ভালো লেখার চেষ্টা করে, তাদেরকে আন্তরিকতা প্রদর্শন করতে হবে সকল কবি লেখককে। যারা লেখা চোরাচোরি করে তাদেরকে শুধরাতে হবে।

লেখাচোর নাকি প্রাচীন কালেও ছিলো। কিন্তু ধরা পড়তো অনেক অনেক বছর পরে! ফেইসবুক অথোরিটির বদৌলতে আমরা আমাদের শিল্প সংস্কৃতি চর্চা করতে পারছি। ধর্ম কর্ম ক্রীড়া ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প পণ্য বিক্রি সব কিছু-ই তো চলছে।

রেষারেষি ঘেঁষাঘেঁষি কাঁদা ছুড়াছুড়িও চলছে এখানে প্রতি মূহুর্তে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে যদি বলা যায় এখন সাহিত্য চর্চার মহাকাল চলছে তাও ঠিক। যদি বলেন- আকাল চলছে, তাও বলা যায় নিঃসন্দেহে। যাদের জ্ঞানের পরিধি যেমন, তাদের ধ্যান ধারণাও তেমন।

আমার অনেকজন বিজ্ঞ বন্ধু রয়েছেন,যারা দুই দিন কথা বললে মনে করেন কয়েক বছর কথা হয়নি। তাদের অভিমত হচ্ছে, যারা একটু বেশী বেশী ফলোয়ার দেখে লাইক কমেন্ট দেখে আত্ম গরিমায় গদগদ হয়ে যাবে, তারা হয়তো বা এক সময় বিলীন হয়ে যাবে।

লেখালেখি গবেষণা করে শিল্প সাহিত্য মান নির্ধারণ করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ, পত্র পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সাহিত্য গবেষকগণ। যারা তাদের লেখাকে এখানে মাইনাস করেছেন এবং অনলাইনের উপর নির্ভর করছেন, তাদের ভবিষ্যত কেমন হবে? বলা মুশকিল। জয় হোক শিল্প সাহিত্যের।

মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীঃ কবি, চেয়ারম্যান- বাংলাদেশ পোয়েটস ক্লাব।