ই-পেপার | শুক্রবার , ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মৌলভীবাজারে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের রায় অনুযায়ী মন্দির হচ্ছে

সালেহ আহমদ (স’লিপক), সিলেট:

হিন্দু ট্রাস্টের রায়ে মৌলভীবাজার শহরের পুরাতন কালীবাড়িতে নিজেদের জায়গায় মন্দির নির্মিত হচ্ছে। এখানে কোনো দোকান-দালান হবে না। এটি দ্রুত বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবেন বলে জানিয়েছেন মৌলভীবাজারে জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম। তিনি সশরীরে পুরাতন কালীবাড়ির নির্মাণ কাজ ঘুরে দেখেন।

 

বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক, ড. উর্মি বিনতে সালাম পুরাতন কালিবাড়ি মন্দির পরিদর্শন করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) প্রভাংশু সোম মহান।

 

এর আগে বুধবার বিকেলে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে শহরের হিন্দু সমপ্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে কালীবাড়ির নির্মাণ কাজসহ সার্বিক বিষয়ে জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালামের সভাপতিত্বে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এসময় মৌলভীবাজার শহরে অবস্থিত পুরাতন কালীবাড়ির নির্মাণ কাজ সম্পর্কে আলোকপাত করার জন্য উপস্থিত সদস্যদের অনুরোধ করলে সকলেই মন্দিরের পক্ষে কথা বলেন।

 

সভায় কালীবাড়ি কার্যকরি কমিটির সভাপতি, সাবেক পৌর কাউন্সিলর মনবীর রায় মঞ্জু বলেন, একই কমিটির মাধ্যমে পুরাতন ও নতুন কালীবাড়ি পরিচালিত হয়। পুরাতন কালীবাড়ির জরাজীর্ণ দোকান ও মন্দির ভেঙে নতুন করে নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। নির্মাণ কাজের জন্য হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট হতে ১৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বরাদ্দপ্রাপ্তির পর নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। মন্দিরের ঢালাইয়ের কাজ সমাপ্ত হলে কতিপয় ব্যক্তির আপত্তির কারণে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করেন। সে প্রেক্ষিতে অদ্যাবধি কাজ বন্ধ রয়েছে। তিনি এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে কাজ আরম্ভ করতে আগ্রহী বলে জানান।

 

মনবীর রায় মঞ্জুর বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করেন দেবতোষ সিংহ চৌধুরী, মহিম দে, আশুতোষ দাশ প্রমুখ।

তারা বলেন, মায়ের মন্দির হোক সেটা সবাই চায়। মন্দিরে পূর্বেই দোকান ছিল। বর্তমানেও দোকান রেখেই মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। বর্তমানে নিচে দোকান রেখে উপরে কালীমন্দির স্থাপনের নকশা করা হয়। দোকান নির্মাণের কারণে প্রতিপক্ষের আপত্তি পাওয়া যায়। বর্তমানে যে সিদ্ধান্ত হবে সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক মন্দিরের অসমাপ্ত নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন তারা।

রনধীর রায় কানু বলেন, একই কমিটির মাধ্যমে পুরাতন ও নতুন কালীবাড়ি পরিচালিত হচ্ছে। এ কারণেই সমস্যার সৃষ্টি। নতুন কালীবাড়ি কার্যকরী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। দোকানের ভাড়ার টাকা মন্দিরের কাজে ব্যবহার করা হয়নি। বর্তমানে মন্দিরের জায়গা মাত্র ৩ শতক। মন্দিরের জায়গায় দোকান ভাড়া দেয়া হলে মন্দিরের পূজা অর্চ্চনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনায় সমস্যার সৃষ্টি হবে। তাছাড়া ভবিষ্যতে ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ীদের অপসারণে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হবে।

 

তিনি মন্দিরের জায়গায় মন্দির নির্মাণের বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। তাছাড়া তিনি মন্দিরের জায়গায় মন্দির নির্মাণ করার ব্যাপারে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে নির্দেশনা পাওয়া গেছে মর্মে সভাকে অবহিত করেন। তিনি সর্বশেষ হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট হতে প্রাপ্ত নির্দেশনা মোতাবেক মন্দিরের নির্মাণ কাজ দ্রুত বাস্তবায়নের অনুরোধ করেন।

 

রনধীর রায় কানুর বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন, এড. পীযূষ কান্তি সেন, এড. দীপ্তেন্দু দাশগুপ্ত কাজল, এড. প্রদীপ দাশ, এড. রুনু দত্ত (রনজু) প্রমুখ।

 

তারা বলেন, কালীবাড়ির মন্দিরের জায়গায় মন্দির নির্মাণ করা হলে তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং মন্দিরের ভাবগাম্ভীর্যতা বজায় থাকবে।

 

সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় যে, পুরাতন কালী বাড়ির অসমাপ্ত নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন, মন্দিরের পূজা অর্চনার কার্যাদি ২য় তলায় সম্পন্ন করা, মন্দিরের নীচতলা মন্দিরের কাজে ব্যবহার ও কোন দোকান থাকবে না।

 

মন্দিরের অসমাপ্ত নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করার জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কে আহবায়ক করে সভায় উপস্থিত উভয় পক্ষের সমন্বয়ে সর্বসম্মতিক্রমে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

 

কমিটির সদস্যরা হলেন, নতুন কালীবাড়ি সভাপতি মনবীর রায় মঞ্জু, সহ-সভাপতি আশুরঞ্জন দাশ, সহ-সভাপতি দেবতোষ সিংহ চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহিম দে, সদস্য এড. রুনু দত্ত (রনজু), এড. প্রদীপ দাশ, এড. পীযূষ কান্তি সেন, এড. দীপ্তেন্দু দাশগুপ্ত কাজল, রনধীর রায় কানু, নকুল চন্দ্র দাশ।

 

এবিষয়ে এড. দীপ্তেন্দু দাশগুপ্ত কাজল বলেন, আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি হিন্দু ট্রাস্টের রায় মৌলভীবাজারের পুরাতন কালীবাড়িতে মন্দিরের জায়গায় মন্দির হবে, এখানে কোন দোকান হবে না! এই দোকান নিয়েই একটি বিভাজন সৃষ্টি হয়। জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে আমরা উভয়পক্ষের মধ্যে একটি দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে পেরেছি। আলোচনা সভায় আরেকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) প্রভাংশু সোম মহানকে আহবায়ক করে উভয় পক্ষের পাঁচ জন করে ১০ জনসহ মোট ১১জন দিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে।

 

নতুন কালীবাড়ির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সম্পাদক মহিম দে বলেন, আমরা তো প্রথম থেকেই বলে আসছি যে হিন্দু ট্রাস্টের রায়ে মৌলভীবাজারের পুরাতন কালীবাড়িতে মন্দিরের জায়গায় মন্দির হবে। মন্দির নিয়ে তো কোন দ্বিমত ছিলনা। আমরা প্রথমেই বলেছি এখানে জায়গা কম। তাই দোতলায় মন্দির হবে। পূর্বেই মন্দিরের পাশে দোকান-কোঠা ছিল, তাই বহালের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমরা তো কখনো মন্দিরে বিপক্ষে ছিলাম না। আমরা জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে দীর্ঘদিনের সমস্যাটি সমাধান হওয়ায় সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

 

উল্লেখ্য, মৌলভীবাজারে কালী মন্দিরের জায়গায় মন্দির নির্মাণের আদেশ দিয়ে ১৯ মার্চ সচিব (উপসচিব) কৃষ্ণন্দু কুমার পাল স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত পত্র জেলায় প্রেরণ করা হয়। শেষ পর্যন্ত হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের রায়ে ও এলাকাবাসীর দাবি প্রতিফলিত হলো। সেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মৌলভীবাজার শহরের পুরাতন কালীবাড়িতে মন্দির নির্মাণ করতে হবে। কোন অবস্থায় দোকান-কোঠা নির্মাণ চলবে না।

 

এর আগে হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট্রের আওতায় মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ মন্দিরের জায়গায় শুধুমাত্র মন্দির নির্মানের জন্যই ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও তার ব্যত্যয় ঘটে।

 

সারাদেশে সনাতন ধর্মালম্বীদের মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও সংস্কার শীর্ষক প্রকল্প এর আওতায় শুধু একতলা বা দ্বিতল মন্দির নির্মানের নির্দেশনা থাকলেও তার ব্যতিক্রম ঘটেছে মৌলভীবাজারে।

 

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলা শহরের পুরাতন কালীবাড়ি মন্দির প্রায় ১৪০ বছরের পুরনো। ঐতিহ্যবাহী এই মন্দিরের নতুন নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে। সূচনালগ্নে ইঞ্জিনিয়ারিং ত্রুটির কারণে কমিটির নির্মাতারা উদাসীন থাকায় নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার দেখে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা রাজ সরকার উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কাজ বন্ধ করেন এবং প্রশাসনিক নির্দেশ মোতাবেক ছাদ ঢালাই ভেঙ্গে পুণরায় ছাদ নির্মিত হয়।

 

পরবর্তীতে বাংলাদেশ হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপপরিচালক প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস বিগত ২৭ অক্টোবর ২০২২ মৌলভীবাজার পুরাতন কালী মন্দির নির্মাণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো সরজমিনে পরিদর্শন করেন।