@ মনজুরুল হাসান @
চুল কাটা বা ক্ষৌরকর্ম মানব সভ্যতায় চলমান জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য বিষয়। বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই যে দেশে নাপিত নেই ।
তো আগের দিনে কেমন ছিল কক্সবাজারে নরসুন্দর বা নাপিত- যখন আধুনিক সেলুন বা নাপিতের দোকান ছিল না!
ছোটবেলায় বাবার সাথে বাজারে গেলে দেখা যেতো কক্সবাজার শহরের চাউল বাজারের পূর্বেপাশে বাবু ক্য-ছিং এর রেশন দোকানের পশ্চিম পাশে নালার ধারে সারি ধরে অনেক নাপিত বসে আছে।
একজন একটা ইটের উপর বসে গায়ে সাদা কাপড় জড়িয়ে মাথা নীচু করে আছে, আর নাপিত বাবু কুঁজো হয়ে চুল-দাড়ি কাটছে । পাশেই গাছে লটকানো বাঁধা আছে একটা আয়না । চুলকাটা শেষে কাস্টমার তার নিজেকে দেখে নেবে, কেমন হয়েছে চুল কাটা ।
অনেকে রসিকতা করে বলতো ইটালিয়ান সেলুন। যদিও ইটালি বিষয়ক কিছু নয়, তবে ইটের উপর বসে কাজ সারতে হয় বলে ইট থেকে ইটালিয়ান শব্দ!
সত্তর-আশির দশক পর্যন্ত ছিল এরকম রাস্তায় বসে চুল কাটার দৃশ্য। পরবর্তীতে আধুনিক সেলুনের দোকান চালু হলে এখন এই দৃশ্য আর চোখে পড়ে না ।
কেউ কি কেটেছেন এভাবে রাস্তায় বা ঘরের উঠোনে বসে চুল-দাড়ি? ছোটবেলায় আমাদের জন্য নাপিতকে ঘরে ডেকে আনা হতো। সেকালের ভ্রাম্যমান নাপিত বাবুর একটা ছোট কাঠের বাক্সের ভেতরে থাকতো চুল কাটার যন্ত্রপাতি; কাঁচি, চিরুনি, আয়না, সাবান ইত্যাদি। যন্ত্রপাতি ভরা এরকম একটা বাক্স নিয়ে নাপিত ঘরে ঘরে যেতো, শিশু বা বড়দের চুল কাটতে। উঠোনে মাটিতে বা মোড়াতে বসে চুল কাটা হতো। কোনো কোনো গৃহস্থের সাথে মাসিক চুক্তিতে বা গ্রামে নির্দিষ্ট পরিমাণে চাউল বা ধানের বিনিময়ে ওই ঘরের সবার চুল কাটা হতো ।
আবার বিশেষ সমাদর করে নাপিত ডাকতে হতো ঘরে কোন নবজাতকের প্রথমবার মাথা মুন্ডন করতে হলে। স্থানীয় ভাষায় এটাকে বলা হতো বাচ্চার ‘হুইদ তোলা’। এটা অবশ্য একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার।
একটা ডালা-কুলাতে রাখা হতো তিন-চার সের বা কেজি পরিমাণে চাল, পিঁয়াজ, রসুন, হলুদ, শুকনো মরিচ ইত্যাদি বা ওই ধরণের রান্নার মশলাপাতি, দুর্বাঘাস, কলাপাতা ইত্যাদি ।
নাপিত বাবু বিভিন্ন সূরে গান-গীত বা ঐতিহ্যবাহী হঁ-লা গীত গেয়ে গেয়ে অত্যন্ত যত্ন করে নবজাতকের চুল মুন্ডিত করতো। নবজাতকের প্রথমবারের চুলগুলো মুন্ডিত হলে কলাপাতায় মোড়ে যত্ন করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো
‘হুইদ তোলা’র এই আনুষ্ঠানিক কাজে আমাদের এলাকায় বিশেষভাবে পারদর্শী টুনু বা টুইন্না নামের একজন বয়স্ক নাপিত ছিলো। একটু বেঁটে এবং শীর্ণকায় শরীরে পরনে মহাত্মা গান্ধী জ্বী স্টাইলে সাদা ধুতি পরা। মাথা মুন্ডনের কাজ শেষে সে নবজাতককে কোলে নিয়ে হঁ-লা গীতের সূরে সূরে পুরো উঠোনজুড়ে ঘুরে ঘুরে নাচতো ।
নবজাতকের ‘হুইদ তোলা’র আনুষ্ঠানিক কাজে টুইন্না নাপিতের বাড়ি বাড়ি বিশেষ ডাক পড়তো। কাজ শেষে যাবার বেলায় তার জন্য থাকতো বিশেষ উপঢৌকন; ডালা-কুলায় দেয়া ওই জিনিসগুলো এবং খুশি হয়ে বড় অঙ্কের বখশিসের টাকা।
কক্সবাজারে এখনও বংশানুক্রমে নাপিত বা শীলদের আবাস হচ্ছে বাঁকখালি নদীর উত্তর পাড়ে খুরুশকুল গ্রামে। সেকালের সেই টুনু, যতিন, বাবুল, দীনেশ নাপিতের কেউ আজ বেঁচে নেই । সেসব আনুষ্ঠানিকতাও আজ আর নেই। নেই সেই ইটালিয়ান সেলুন।
এখন হয়েছে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক সেলুন। তবে ছবির মতো নাপিত এখনও অবশ্য আছে গ্রামের সাপ্তাহিক হাট-বাজারে। বছর পাঁচেক আগে ছবিটা ধারণ করেছিলাম রামু উপজেলার কলঘর এলাকায়, এক গ্রামীন হাটের দিনে।