পেকুয়া প্রতিনিধি :
যাদের দায়িত্ব বন রক্ষার তারাই যদি বন নিধনের ভূমিকা পালন করে তাহলে বনতো উজাড় হবেই। সম্প্রতি কক্সবাজারের পেকুয়ায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অবৈধ ভাবে ৪ লাখ ঘনফুট বালি উত্তোলন করতে পাহাড় খেকোদের সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে স্বয়ং বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হকের বিরুদ্ধে। এ যেন রক্ষকই ভক্ষক।
বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক টইটং মৌজার মধুখালী এলাকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে ৪ লাখ ঘনফুট বালু পরিত্যাক্ত অবস্থায় জব্দ করে গত ২৫ মে ২০২৩ তারিখে বন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৪১ ও ৪২ ধারা মতে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে উল্লেখ করলেও কোন ব্যাক্তিকে আসামী করা হয়নি। এতে রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হকের ভূমিকা নিয়ে এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
রেঞ্জারের বিরুদ্ধে শুধু বালু উত্তোলন নয় পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি,টাকার বিনিময়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসতবাড়ি নির্মাণে সহায়তা, মাদার ট্রি গর্জন কাট পাচার, ২৮টি করাতকল থেকে মাসিক মাসোহারা হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে।
চলতি বছরের ৫এপ্রিল গভীর রাতে পেকুয়া উপজেলা প্রশাসনের বিশেষ অভিযানে পাহাড়ি মাটি ভর্তি ৪টি ডাম্পার সহ ৪ জনকে আটকের পর রেঞ্জারের এসব কর্মকান্ড প্রকাশ পায়।
আটককৃতরা স্বীকারোক্তিতে বলেন,রেঞ্জার হাবিব স্থানীয় একজন সাংবাদিক ও আবু ছৈয়দের মাধ্যমে রাতে পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করছে দীর্ঘদিন ধরে। তারা রেঞ্জার হাবিবের অনুমতি নিয়ে গভীর রাতে পাহাড় কেটে মাটি সরবরাহের কাজ করে। কোন সমস্যা হলে রেঞ্জার নিজেই দেখবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের কাজে লাগায়।
আটককৃতরা আরও বলেন,রেঞ্জার হাবিব স্থানীয় কিছু সাংবাদিক ও তাদের অনুসারী লোকজন দিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরী করে পাহাড়ের মাটি বিক্রি করে প্রতিমাসে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
পরিত্যক্ত অবস্থায় ৪লাখ ঘনফুট বালু জব্দ দেখিয়ে বন আইনে মামলা দায়ের এবং মামলায় কোন ব্যাক্তিকে আসামি না করায় রেঞ্জারের ভূমিকা নিয়ে ইতোমধ্যে জনমনে নানান প্রশ্নের জন্মদেয়।এবিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়,টইটং বনকানন এলাকার জাকের হোসেন গত বর্ষা মৌসুমে রেঞ্জার হাবিবকে ৫লাখ টাকা দিয়ে মৌখিক চুক্তি করে মধুখালি এলাকায় বালু উত্তোলন শুরু করে।
যে বালু নিয়ে পত্র পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়েছে সে বালুর পিছনে মুল কারিগর রেঞ্জার হাবিবুল হক নিজেই। প্রকৃত বালু উত্তোলনকারী জাকের হোসেন এই প্রতিবেদককে জানান,রেঞ্জার হাবিবের সাথে চুক্তি ভিত্তিক টইটং এর বিভিন পাহাড়ি ছড়ায় ছোট বড় প্রায় ৫টি বালু উত্তোলনের স্পট রয়েছে, এসব স্পট থেকে আমরা প্রতি মাসে রেঞ্জারকে ৫ লাখ টাকা দিয়ে থাকি। তার মধ্যে মদুখালী বালু স্পটটি হলো আমার এবং সবচেয়ে বড় স্পট।
সম্প্রতি যে ৪ লাখ ঘনফুট বালু জব্দ ও পরবর্তীতে বন আইনে মামলার বিষয়ে জাকের হোসেন বলেন, মুলত মধুখালি বালুর স্পটটি আমার। ওই স্পটে কাজ শুরুর আগে রেঞ্জার হাবিবরে সাথে ২৫ লাখ টাকার একটি মৌখিক চুক্তি হয়। কাজ শুরুর আগে রেঞ্জারের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করে মৌখিক চুক্তি হয়। চুক্তির প্রথম কিস্তি ৫ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে বালু উত্তোলনের কাজ আরম্ভ করি। কথা ছিল পুরো বর্ষা মৌসুম বালু উত্তোলন করে মধুখালি এলাকায় মওজুদ করবো, বর্ষা শেষে উক্ত বালু বিক্রি করে রেঞ্জারকে তার ভাগের বাকি ২০ লাখ টাকা পরিশোধ করবো। চুক্তিমতে অগ্রিম ৫ লাখ টাকা রেঞ্জারকে নগদ বুজিয়ে দিয়ে কাজে নেমে পড়ি।
ছোট বড় ৫টি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে পুরো বর্ষা মৌসুম বালু উত্তোলনের কাজ চালিয়ে যাই। রেঞ্জার প্রতি মাসে স্পটে গিয়ে কি পরিমান বালু উত্তোলন হয়েছে পরিদর্শনে যেতেন।নির্ধারিত স্পট ছাড়া আমার লোকজন দিয়ে হারবাং মৌজা থেকে বালু উত্তোলন করে মধুখালিতে স্টক করি।
পুরো বর্ষা মৌসুম বালু উত্তোলনে আমার ২০ থেকে ৩০ জন শ্রমিক কাজ করতো,এসময় পাহাড়ে আমরা বিশ্রামহীন কর্মযজ্ঞ চালিয়েছি,এতে আমার প্রায় ৩০ লাখ টাকা পুঁজি খরচ হয়েছে।
সব কিছু ঠিক ছিল কিন্তু বর্ষা শেষে বালু উত্তোলন প্রায় সমাপ্তের দিকে,সে সময় রেঞ্জার হাবিব একদিন স্পট পরিদর্শনে যায়, তিনি গিয়ে বালুর স্তুপ দেখে কি পরিমান বালু উত্তোলন হয়েছে জানতে চায়,পরে বালুর পরিমান বেশী জেনে রেঞ্জারের লোভ জন্মে যায়। রেঞ্জার আমাকে বলে তার ভাগের ২০ লাখ টাকা বালু স্পট থেকে সরানোর আগেই পরিশোধ করতে হবে নাহয় বালু এখান থেকে যাবেনা বলে জানান। রেঞ্জারের এমন আচরণে আমি অসহায় হয়ে পড়ি। রেঞ্জারকে আপনার সাথে এধরনের কথা ছিলানা ,আমি অনেক বুজিয়ে বলি বালু সাপ্লাইয়ের আগে এত টাকা কোথায় পাব,তখন তিনি বলেন বালু সাপ্লাইয়ের পার্টি আমার কাছে তুমি তাদের সাথে কথা বলে কন্ট্রাক্ট করে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমার ভাগের টাকা আমাকে বুজিয়ে দাও।
পরে আমি কয়েকটা পার্টি স্পটে নিয়ে গিয়ে কথা বলি,পার্টি বালুর পরিমান বেশী হওয়ায় কোন ঝামেলা হবে মনে করে অগ্রিম টাকা দিতে রাজি হয়নি।এদিকে রেঞ্জার আমার অগোচরে অন্য পার্টির সাথে কথা বলে বালু সাপ্লাই দিতে টাকা নিয়ে নেন।
এরই মধ্যে একদিন রেঞ্জার আমাকে অফিসে ডেকে বলে ডিপো থেকে বালু উত্তোলনের ব্যাপারে নির্দেশ আসছে এটা আমাকে জব্দ দেখাতে হবে তুমি কয়েক দিন চুপ করে থেকো। তোমার নামে মামলা দিবনা জাস্ট পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার দেখিয়ে মামলা দিব পরে সব কিছু ঠিক হয়ে গেলে তুমি আমার ভাগের টাকা দিয়ে বালু নিয়ে যাবে।
পরে কাউকে আসামী না করে একটি মামলা দিল। মামলা হওয়ার পরে একদিন খবর আসে মামলার আলামত বালু গুলো তিনি অন্য একটি পার্টিকে দিয়ে সাপ্লাই দিতে থাকে। বর্তমানে জব্দকৃত বালু থেকে দেড় লাখ ঘনফুট বালু রেঞ্জার বিক্রি করে টাকা নিয়ে নেন।
রেঞ্জারকে জিজ্ঞাস করি কেন আমাকে এত টাকা লস করালেন ,আপনার কথা মত আমি চুপ করে ছিলাম,মামলা হওয়ার পর আপনি এই বালু অন্যদের কেন বিক্রি করছেন জবাবে তিনি বলেন এখনও সময় আছে ২০ লাখ টাকা নিয়ে এসো বালু পেয়ে যাবে। এরই মধ্যে একদিন পত্রিকায় এবিষয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেঞ্জার বিভিন্ন স্পটে অবৈধভাবে উত্তোলনকৃত বালু বিক্রি করতে বালু উত্তোলনকারী ও বালু ব্যবসায়ীদের মাঝে বালু বিক্রির লিখিত চুক্তি করিয়ে দেন। চুক্তির মাধ্যমে বিকিকিনির নির্ধারিত টাকা থেকে নিজের ভাগের টাকা অগ্রিম নিয়ে নেন এমন লিখিত চুক্তিপত্রও পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, রাত হলে পাহাড় থেকে নেমে আসে মাটি ভর্তি ডাম্পারের বহর। স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলে বন মামলার ভয় দেখিয়ে হুমকি দেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কাঠ ব্যবসায়ী বলেন, প্রতি মাসে এক লাখ টাকা দেয়ার পরেও রেঞ্জারের টাকার প্রয়োজন হলেই মাঝে মাঝে গাছের ডাম্পার আটক করে মামলার ভয় দেখায় বাধ্য হয়ে আবার টাকা দিয়ে গাড়ি ছাড়িয়ে আনতে হয় ।
রিজার্ভের জায়গায় বসবাসরত হাছিনা আক্তার জানান,আমি একজন ভূমিহীন মহিলা পাহাড়ে জায়গা ক্রয় করে ঘর উঠাতে চাইলে রেঞ্জার হাবিব আমার কাছে এক লক্ষ টাকা দাবী করে পরে রেঞ্জারের সিন্ডিকেটের একজনের সহযোগিতায় ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ঘর উঠাতে হয়েছে।
এবিষয়ে স্থানীয় পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক নাগরিক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)’র পেকুয়া ্উপজেলা শাখার উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট কামাল হোসেন বলেন,অবৈধ ভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে ৪ লক্ষ ঘনফুট বালু উত্তোলন করে স্তুপ করা এটি অনেক সময়ের ব্যাপার কিন্তু বন রক্ষার দায়িত্বে থাকা রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক চোখ বন্ধ করে তাদেরকে কি সহায়তা করে আসছিল এটি প্রশ্ন । পরে বিষয়টি পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হলে বালু গুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার দেখিয়ে বন আইনে মামলা করলো কোন ব্যাক্তিকে আসামী করা হলোনা এটিও আরেকটি প্রশ্ন, বন বিভাগ এটার দায় এড়াতে পারেনা। এখানে পাহাড় খেকো ও রেঞ্জারের জোগসাজশ রয়েছে এটি দিনের আলোর মত সত্য। যারা পাহাড় রক্ষার দায়িত্বে থেকে পাহাড় খেকোদের সহযোগিতা করে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করছে এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জোর দাবি জানান।
ঘটনার বিষয়ে অভিযুক্ত বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, আমি পাহাড়া খেকোদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছি।মধুখালীতে ৪লাখ ঘনফুট বালু জব্দ করে মামলা হলো কোন ব্যাক্তিকে আসামী করা হয়নি কেন এবিষয়ে জানতে চ্ইালে উত্তরে তিনি বলেন, বালু গুলো পরিত্যাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করি কোন মালিক না থাকায় কাউকে আসামী করা হয়নি।
জাকের হোসেন মধুখালী স্পটটি আপনার সাথে ২৫ লাখ টাকায় মৌখিক চুক্তি করে অনুমতি নিয়েছে এবিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরে তিনি বলেন, জাকের হোসেন একজন পাহাড়খেকো তার বিরুদ্ধে আমি বন আইনে মামলা দিয়েছি তাই সে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে ।
জব্দকৃত ৪ লাখ ঘনফুট বালু গুলো মামলার আলামত এখান থেকে বালু বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে আপনার বিরুদ্ধে এবিষয়ে জানতে চাইলে জচবাবে তিনি বলেন, আদালত এবিষয়ে আদেশ দিয়েছে বালু পরিমাপের জন্য পরিমাপের পর বালু কম হলে তখন প্রমান হবে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, বনাঞ্চল রাষ্ট্রিয় সম্পদ এ সম্পদের পাহারাদার হলেন বন বিভাগ, এ রাষ্ট্রিয় সম্পদ বিক্রি করার অধিকার কারও নেই। যদি কেউ এমন কোনো কাজ করে থাকে, তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ অবৈধ। এ বিষয়ে তিনি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।