মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, ময়মনসিংহ:
ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন ভোটের বাকি আর মাত্র একদিন। বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ ২০২৪) তারিখে শেষ হবে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। শেষ মুহুর্তে বিরামহীন প্রার্থীরা দৌঁড়ঝাপ চালিয়ে যাচ্ছেন ভোটারদের সমর্থন পেতে। অন্যদিকে ভোটাররাও অপেক্ষার প্রহর গুনছেন ভোটের দিনের জন্য। আর সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠানের লক্ষে সব ধরনের প্রস্তুতি থাকার কথা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভোটকে কেন্দ্র করে মিছিল, মিটিং, গান, স্লোগান, মাইকে প্রচারণা, বিভিন্ন মোড়ে ক্যাম্পিং, বাসায় বাসায় গিয়ে ভোট প্রার্থনা, লিফলেট হাতে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অবিরাম ছুটে চলা, ভোট প্রার্থনা সবমিলে ময়মনসিংহ এখন ভোটের কলরবে দিনরাত জেগে থাকা এক নগরীতে পরিণত হয়েছে ময়মনসিংহ।
ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসায় এক দিকে যেমন গতি পেয়েছে প্রচার-প্রচারণা তেমনি নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের পক্ষ-প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধমকির কারণে কোথাও কোথাও সাধারণ ভোটারদের মাঝে কিছুটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। এসব ঘটনায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা শঙ্কা।
তবে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠানের লক্ষে সব ধরনের প্রস্তুতি থাকার কথা জানিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে বলেই প্রত্যাশা করছেন নগরবাসী।
এবার নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বাদে অন্য কোনো দলের নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসেননি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ দলীয় প্রতীক না দিয়ে নির্বাচনকে উন্মুক্ত ঘোষণা করায় দলটি থেকে একাধিক নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। ফলে নির্বাচন বেশ প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক নেতারা।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইকরামুল হক টিটু দেয়াল ঘড়ি প্রতীক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহ্তেসামুল আলম ঘোড়া প্রতীক, শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাড. সাদেকুল হক খান মিল্কী টজু হাতি প্রতীক ও কৃষক লীগ নেতা কৃষিবিদ ড. রেজাউল হক হরিণ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির মনোনিত প্রার্থী হিসেবে শহীদুল ইসলাম স্বপন মণ্ডল লড়ছেন দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে।
ভোটের মাঠের প্রচার প্রচারণা ও আলোচনা সমালোচনায় এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের মাঝেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে নির্বাচন সচেতনদের অভিমত। অনেকেই মনে করছেন শেষ পর্যন্ত বর্তমান মেয়র ইকরামুল হক টিটুর দেয়াল ঘড়ি ও আওয়ামীলীগ নেতা সাদেকুল হক মিল্কি টজুর হাতি প্রতীকের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত মূল প্রতিদ্বন্দ্বি হতে পারে।
তবে সরকার বিরোধীদের মতে, বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো নির্বাচনে না আসায় ভোটের মাঠে আওয়ামীলীগ বিরোধীদের ভোট এবং নিরবে থাকা সাধারণ ভোটগুলো একটা বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে। আওয়ামী বিরোধী ভোটারদের কতজন ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হন সেটিও একটি বড় বিষয়। তবে কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় ওই সকল ভোটারদের একটা অংশ কেন্দ্রে উপস্থিত হবে বলে ধারণা করছেন অনেকেই। সেক্ষেত্রে এই সকল নিরব ভোটারদের ভোটই জয়পরাজয় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
এদিকে ভোটারদের মন জয় প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে আলাদা আলাদা সংবাদ সম্মেলন করে উল্লেখযোগ্য মেয়র প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী ইস্তেহার ঘোষণা করেছেন।
পাঁচজন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের তিনজন প্রার্থী ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বেশ কয়েক দফা প্রতিশ্রুতি সংবলিত নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন।
এর মধ্যে ময়মনসিংহ সিটি আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাতি প্রতীকের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাদেকুল হক খান মিল্কী টজু ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৫ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের নির্বচন পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। এরপর শনিবার (২ মার্চ) জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘোড়া প্রতীকের মেয়র প্রার্থী এহতেশামুল আলম ২০ দফা প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন।
একদিন পর ৩ মার্চ ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন সদ্য সাবেক মেয়র ও টেবিল ঘড়ি প্রতীকের মেয়র প্রার্থী ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটু। তিনিও ২৩ দফা বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করেছেন।
নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য মেয়র প্রার্থীরা নগরবাসীকে যেভাবে সমস্যার সমাধান ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন, সেটি তাদের পক্ষে কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব কিংবা তাদের সক্ষমতা কতটুকু-এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সচেতন নাগরিক সমাজের কাছে।
এ বিষয়ে সিপিবি ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট এমদাদুল হক মিল্লাত সিএনএন বাংলা২৪ কে বলেন, সস্তা বাহবা ও ভোটারদের মন কাড়তে নির্বাচনের মাঠে বহু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তার কতখানি বাস্তবায়ন সম্ভব হয় সেটা দেশের সব মানুষেরই জানা। ভোট এলে সব সময়ই এমন প্রতিশ্রুতি মানুষ পান কিন্তু তার বাস্তবায়ন সামান্যই দেখাতে পারেন।
অন্যদিকে মেয়র প্রার্থীদের পাশাপাশি কাউন্সিলর প্রার্থী থেমে নেই। তারাও প্রচার-প্রচারণা চালাতে গিয়ে ভোটারদের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যেসমস্ত কাজ কাউন্সিলরদের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় নির্বাচিত হলে সেগুলোও বাস্তবায়ন করে দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কাউন্সিলর ও নারী কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
এছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন ওয়ার্ডে একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় নানাভাবে বাঁধা-বিঘ্ন সৃষ্টির অভিযোগ উঠছে। একাধিক ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা ও ভাংচুরের অভিযোগও রয়েছে।
প্রচার-প্রচারণার অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার দেয়াল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী ইকরামুল হক টিটু নগরীর বিদ্যাময়ী স্কুল এলাকা, কলেজ রোড, নওমহল, নাহারোড, সানকিপাড়া এলাকায় কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গণসংযোগ চালিয়েছেন।
হাতি প্রতীকের প্রার্থী সাদেকুল হক খান টজু মিল্কি চরপাড়াসহ আশপাশের এলাকায়। ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী এহতেসামুল আলম ব্রীজ মোড়, র্যালির মোড়সহ আশপাশের এলাকায় গণসংযোগ করেছেন।এছাড়া অন্যান্য প্রার্থীরা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ ও ভোট প্রার্থনা করেছেন। তারা প্রত্যেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন ও নিজেদের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী এহতেশামুল আলম বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ ভালো থাকবে ও সুন্দর থাকবে আচরণ বিধি মেনেই আমরা কাজ করছি। নির্বাচন কমিশন ফেয়ার একটা জাতীয় নির্বাচন উপহার দিয়েছে যা সারা পৃথিবী স্বাগত জানিয়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সৎ যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছে।
জাতীয় পার্টির লাঙল প্রতীকের প্রার্থী শহিদুল ইসলাম স্বপন মণ্ডল বলেন ‘আওয়ামী লীগের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হবে। আর এখানে জাতীয় পার্টির বড় ভোট ব্যাংক রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।
হাতি প্রতীকের প্রার্থী সাদিকুল হক খান মিল্কী বলেন, আমি জয়ী হলে পরিচ্ছন্ন ও যানজটমুক্ত সুন্দর একটি নগরী গড়ে তুলবো। সেজন্য নগরবাসী আমাকেই বেছে নিবেন বলে আমি আশাবাদী। নির্বাচন কমিশন বলছেন প্রার্থী যদি অনিয়ম করে তার প্রাার্থীতা বাতিল হবে। নির্বাচন কমিশন যদি কঠোর থাকে তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠ হবে।
ঘড়ি প্রতীকের মেয়র প্রার্থী ইকরামুল হক টিটু বলেন, উন্নয়নের অসমাপ্ত কাজ করতে নগরবাসী আবারও আমার ঘড়ি প্রতীকে আস্থা রাখবেন। বিগত পাঁচ বছরে বৈশ্বিক সংকটের কারণে শতভাগ উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। সাধারণ মানুষ আমার প্রতি তাদের সমর্থন দিলে চলমান উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করতে পারবো। সাধারণ জনতার পাশাপাশি নেতাকর্মীরাও আমার সঙ্গে রয়েছেন। আশা রাখছি, জয় সহজেই আসবে।
ময়মনসিংহ জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রার্থীদের সতর্ক করার পাশাপাশি জরিমানাও করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলেও ভোটের পরিবেশ শান্ত ও স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশাসন সব সময় সতর্ক অবস্থানে আছে।
এবারের নির্বাচনে ময়মনসিংহ সিটিতে ভোটার তিন লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ জন। এর মধ্যে এক লাখ ৬৩ হাজার ৮৩২ পুরুষ, এক লাখ ৭২ হাজার ৬৫৫ নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৯ জন। ৯ মার্চ ইভিএমে ১২৮ কেন্দ্রে ভোট দেবেন তারা। মেয়র পদে পাঁচ প্রার্থী ছাড়াও নগরের ৩৩টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ১৪৯ এবং ১১ টি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে প্রার্থী আছেন ৬৯ জন। তবে নগরীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ফরহাদ আলম বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ায় ৩২টি ওয়ার্ডে এই পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।