শিব্বির আহমদ রানা, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম)
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার চিরচেনা ছনের ছাউনির মাটির ঘর। কালের পরিক্রমায় আবহমান বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের এই ছনের ছাউনির মাটির ঘর এখন অদৃশ্য। আধুনিকতার উৎকর্ষতায় বর্তমানে বাঁশখালীতে ছনের তৈরি মাটির ঘর বিলুপ্তির পথে বললেই চলে। খুব বেশিদিন হয়নি যেখানে প্রতিটি গ্রামের দুই চারটি ছনের তৈরি ঘর চোখে পড়ত। বর্তমানে কয়েকটি ইউনিয়ন মিলেও এই ধরনের ঘর চোখে পড়েনা। এদিকে টিনের অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। কারণ, দেশে উৎপাদিক অধিকাংশ টিন পরিবেশ বান্ধব নয়।
একসময় যে ছন দিয়ে মানুষ থাকার ঘরের ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করত, এখন তা গ্রামীণ থাকার ঘর থেকে বিলুপ্ত হয়ে আধুনিক জগতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে। পার্কের দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য বৈঠকখানায়, শখের রেস্টুরেন্ট, পাকা বাড়ির সামনে কিংবা বাগানে বসে আড্ডা দেওয়ার ঘর অথবা কোনো শুটিং স্পটে। অনেকের কাছে ছনের বাহারি ব্যবহার দেখে মনে হয় আধুনিকতার এক অনন্য ছোঁয়া। অনেকের পাকা বসতঘরের উপর তলায় ছনের তৈরি ছোট ঘরটিকে ঐতিহ্যের রূপ দেয়। চিরচেনা এই ছন তৎকালে ঘরের ছাউনির জন্য শতভাগ ব্যবহার হতো। ছনই ছিল ঘরের চালার একমাত্র ভরসা।
ঐতিহ্যের ছনের ঘর বিলুপ্তির এ সময়ে ছনের বাজার যেন অবাক করার মতো বিষয়। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ছনের বাজারটি চাম্বলের গোলাম গজের হাটে বসে। বহুকাল থেকে ছনের বাজারটি পরিচিত। চাম্বলের পূর্ব-চাম্বল পাহাড়ি এলাকার দুই শতাধিক লোক পাহাড়ে গভীর অঞ্চল থেকে ছন সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন এ বাজারে। এতে তাদের ভালই রোজগার হচ্ছে। এ ছাড়াও বাঁশখালীর পুইছড়ি,পুকুরিয়া, পৌরসভার মিয়ার বাজার, গুনাগরির রামদাশহাট সহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ক্ষুদ্রাকারের ছনের বাজার বসলেও চাম্বলের বিশালকারের ছনের বাজারটি গ্রামীণ অতীত ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাহাড়ে আগের মতো ছন পাওয়া যায় না। যৎসমান্য ছন বাঁশখালীর পাহাড়ি অঞ্চল থেকে কেটে আনেন পাহাড়ি লোকজন। আগের মতো ছন পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন পাহাড়ি এক চাষী ছৈয়দ নুর। গ্রামাঞ্চলে একসময় ঘরের ছাউনির জন্য ছন ব্যবহার করা হলেও এখন ঘরের রান্নাঘর (পাকঘর) ছাউনির জন্য যৎসমান্য ক্রয় করেন স্থানীয়রা। আমাদের ছনের বড় ক্রেতা পানচাষীরা। এরা ছনকে পানের বরজে ব্যবহার করে। আগের মতো ছন তেমন পাওয়া যায়না পাহাড়ে। তাছাড়া ছনের চাহিদা কমে যাওয়ায় পাহাড়ী চাষীরাও বিমুখ হচ্ছে দিন দিন।
উপজেলার চাম্বল গোলাম গজের হাটে রোববার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ‘বর্তমানে চার হাত থেকে সাড়ে চার হাত লম্বা এক ভার ছনের দাম পাইকারী মূল্য ১ হাজার থেকে ১১শ টাকা। এ বাজারে তিন থেকে চারজন বড় পাইকার ছনচাষী থেকে প্রতিদিন ছন ক্রয় করছে। হাটের বিশাল অংশজুড়ে দীর্ঘ ছনের সারি। এখান থেকে স্থানীয়রা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা ছন ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন।
চাম্বল বাজারের ছনের এক পাইকারী বিক্রেতা মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস থেকে হাট-বাজারে ছন আসা শুরু হয়। ছনের স্থানীয় ক্রেতা তেমন নাই। পাকঘরের ছাউনির জন্য কয়েজন লোক ছন ক্রয় করে। স্থানীয় পানচাষীরা পাহাড় থেকেই ছন সংগ্রহ করে পানের বরজে ব্যবহার করে। আমাদের বড় ক্রেতা মহেশখালীর পানচাষীরা। তারা এখান থেকে পাইকারী দামে ছন ক্রয় করে ট্রাকবোঝাই করে নিয়ে যায়। তবে দিন দিন ছনের চাহিদা কমে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
হাজার বছরের চিরচেনা ছনের ঘর আজ রুপ কথার গল্পের মতো। ছনের ছাউনির ঘরের কথা নবীনদের মন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রামবাংলার আবহমান ঐতিহ্যের ছনের ঘর রূপকথার গল্প কথনের মতো হয়ে যাবে এমনটি বলছেন প্রবীণরা।