ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

প্লাস্টিক বর্জ্য ও জলবায়ু পরিবর্তন

মুজিব উল্ল্যাহ্ তুষার:

১৯৩৩ সালে পলিথিন উদ্ভাবনের পর বিশ্বব্যাপি প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার ক্রমবর্ধমানহারে বেড়েই চলেছে। ১৯৫০ এর দশক থেকে সারাবিশ্বে ৮.৩ বিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হয়েছে এবং এর অর্ধেক পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে গত ১৫ বছরে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপি যত পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, তার প্রায় ৭৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য ল্যান্ডফিল বা প্রকৃতিতে উন্মুক্ত করা হয় এবং প্রায় ১২ শতাংশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই প্লাস্টিক উৎপাদন, ব্যবহার ও বর্জ্যে রূপান্তর হওয়া চক্রে মোট ১.৮ বিলিয়ন টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়েছে, যা বৈশ্বিক নিঃসরণের ৩.৪ শতাংশ। ২০৬০ সাল নাগাদ উৎপাদিত প্লাস্টিকের জীবনচক্র থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ ৪৩ বিলিয়ন টন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব কারণে প্লাস্টিক দূষণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

 

প্লাস্টিক বর্জ্য ও নদী দূষণ:
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বের প্রধান নদী ও মোহনাগুলো প্লাস্টিক বর্জ্যের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। সমুদ্রে পতিত হওয়ার আগে প্লাস্টিক বর্জ্য নদীতে জমা হওয়ার কারণে জলজ প্রজাতিসমূহের আবাসস্থল হ্রাসসহ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটছে। বাংলাদেশের ১৮টি আত্মসীমান্ত নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর ২.৬ মিলিয়ন টন’ সিঙ্গেল ইউ প্লাস্টিক বা একক ব্যবহার প্লাস্টিক পতিত হয়, যা নদী, নৌপথ জলজ প্রজাতি এবং পানির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। প্লাস্টিক বর্জ্যসহ ব্যাপকভাবে বর্জ্য ফেলার কারণে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষা ও কর্ণফুলী নদী এখন বাংলাদেশের অন্যতম দূষিত নদীতে পরিণত হয়েছে।

 

শীতলক্ষা ও কর্ণফুলী নদী এখন বাংলাদেশের অন্যতম দূষিত নদীতে পরিণত হয়েছে।

প্লাস্টিক বর্জ্য ও ভূমিদূষণ:

ভূমিতে প্লাস্টিক দূষণ মানুষ, গাছপালা ও অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সময়ের সাথে সাথে প্লাস্টিকের বড় টুকরো ৫ মিলিমিটার থেকে কম দৈর্ঘ্যে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক আকারে মাটিতে প্রবেশ করে ভূমির গঠন পরিবর্তন করে পানি ধারণ ক্ষমতাকে বিনিষ্ট করছে। ফলে উদ্ভিদ মূলের বৃদ্ধি ও পুষ্টি গ্রহণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্হ হয়। এছাড়া জৈব রাসায়নিক সারে প্রচুর পরিমাণ মাইক্রোপ্লাসাটিক থাকায় তা কৃষিকাজে ব্যবহারের ফলে মাটি দূষিত হচ্ছে। ফলে প্লাস্টিকের মাধ্যমে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে, যা ভূগর্ভস্হ পানি ও অন্যান্য পানির উৎস ও বাস্তুুতন্ত্রে প্রবেশ করে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। ভূমিতে প্লাস্টিকের উপস্থিতি বাস্তুতন্ত্র ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ।

 

প্লাস্টিক দূষণ ও বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি
প্লাস্টিক দূষণ প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে পরিবর্তন করে এবং বাস্তুতন্ত্রের ক্ষমতা হ্রাস করে পৃথিবীতে মানুষ ও অন্যান্য জীবের অস্তিত্বকে বিপন্ন করাসহ লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সন্তা এবং অপচনশীল প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য পরিবেশে উন্মুক্ত করার ফলে মাটি, পানি, বায়ুমণ্ডলের দূষণ বাড়ছে এবং বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও মানবস্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে।

 

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রের প্রায় ৮০০ প্রজাতি প্লাস্টিক দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্লাস্টিক দূষণের ফলে সর্বাধিক কার্বন সঞ্চয়কারী ও ক্রমবর্ধমান সমুদ্রস্ফীতি এবং ঝড়ের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করা চারটি উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র ম্যানগ্রোভ বন, সামুদ্রিক ঘাস, লবণ জলাভূমি ও প্রবাল প্রাচীর ইতোমধ্যেই হুমকির মধ্যে রয়েছে।

 

প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলায় বাংলাদেশের অবস্থান
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হলেও, কার্যকর প্রয়োগের অভাবে প্লাস্টিক থেকে পরিবেশ দূষণ শুধু অব্যাহতই নয় বরং বৃদ্ধিই পেয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) এর ধারা ৬ (ক) অনুসারে পলিখিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ হলেও সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ও লেমিনেটেড প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়নি। এর ফলে আইনের আওতায় কিছু পলিথিনের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকায় প্লাস্টিক দূষণ অব্যাহত রয়েছে। বৈশ্বিক মোট প্লাস্টিক দূষণের ২.৪৭ শতাংশ বাংলাদেশে হয়ে থাকে এবং ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মধ্যে মাত্র ৩৬ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়।

ঢাকা শহরে বর্জ্যের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যের অনুপাতের বৃদ্ধি সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষণীয়। এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্স (ইপিআই)-২০২২ অনুযায়ী, পরিবেশ দূষণ রোধে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। তবে প্লাস্টিক দূষণ কী একটি আকশন প্ল্যান বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। এই পরিকল্পনায় প্লাস্টিক পণ্য হ্রাস, পুনর্ব্যবহার এবং পুনঃচক্রায়ন করার 3R পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা এবং প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাসে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনঃচক্রায়ন করা, ২০২৬ সালের মধ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ৯০ শতাংশ বাদ দেওয়া এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন ৩০ শতাংশ হ্রাস করা।

 

লেখক: সাংবাদিক ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মী।