নিজস্ব প্রতিবেদক,চট্টগ্রাম:
চট্টগ্রাম: সোমালিয়ার দুর্ধর্ষ জলদস্যুরা একে৪৭সহ ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছে এমভি আবদুল্লাহ। যেন পান থেকে চুন খসার জো নেই।
এর রকম দুঃসহ বন্দিদশায় ঈদুল ফিতরের জামাত পড়ছেন জাহাজে জিম্মি ২৩ বাংলাদেশি নাবিক। এর মধ্যে একজন ইমাম।
যার ইমামতিতে হয়েছে জামাত। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি জেটিতে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় সেই ইমাম, জাহাজের ফিটার মোহাম্মদ সালেহ আহমদের সঙ্গে। প্রথমে দেশে ফেরার অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, দেশের মাটিতে ফিরে এসেছি, মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছি এটার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। পুরো দেশ আমাদের জন্য দোয়া করেছে। বিশ্বের যেখানে বাংলাভাষী মানুষ ছিল, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই দোয়া করেছেন। উনাদের প্রতি এ কৃতজ্ঞতা শেষ হবার নয়। উনাদের ধন্যবাদ জানাই। আমরা মজলুম অবস্থায় ছিলাম। জুলুমের শিকার ছিলাম। রোজা অবস্থায় ছিলাম। ওই অবস্থায় দেশবাসীর জন্যও দোয়া করেছি। যাতে সবাইকে সুস্থ রাখেন, নেক হায়াত দান করেন।
ঈদের জামাতে ইমামতি প্রসঙ্গ তুলতেই চোখ ছলছল করে এ সমুদ্রজয়ী নাবিকের। বললেন, আমাদের ক্যাপ্টেন স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ঈদের নামাজ পড়াতে। কলিগরা সবাই সাপোর্ট করেছিলেন। আমি ঈদের নামাজ পড়িয়েছিলাম।
এর আগে কখনো জাহাজে ঈদের নামাজ পড়িয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, এর আগেও জাহাজে ঈদের নামাজ পড়িয়েছি। আমাদের জাহাজে নির্ধারিত কোনো ইমাম থাকেন না। যারা নামাজ পড়েন, কলিগরা সাপোর্ট করলে জামাতে নামাজ পড়ানো হয়। তবে এবারের ঈদের নামাজ ছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, জলদস্যুদের বন্দিদশায় জিম্মি জাহাজে।
সেদিনের অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, জলদস্যুরা ঈদের নামাজ পড়তে দিছে। আমরা নামাজ পড়েছি। আত্মীয়-স্বজনকে মিস করেছি। ওই মুহূর্তে আমাদের দুশ্চিন্তা ছিল, আমরা জীবিত ফিরে আসবো কিনা! আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছি। মোনাজাতের মধ্যে আরবিতে দোয়া করেছি, আল্লাহ যেন জলদস্যুদের রহমত করে। আমরা যেন মুক্তি পাই। আল্লাহ কবুল করেছেন। দেশবাসীর দোয়া ছিল। সরকারের সাপোর্ট ছিল। আমাদের কোম্পানির সাপোর্ট ছিল।
ঈদের দিন কী খেয়েছিলেন জানতে চাইলে বলেন, ঈদের দিন নরমাল খাবার খেয়েছি। দুব্বার মাংস যেভাবে নিউজে আসলে সে রকম নয়। ওদের জন্য আনা হতো। মাঝেমধ্যে আমাদের একটু শেয়ার করতো। এমন না যে, কনটিনিউ দুব্বার মাংস খাইয়েছে। ধরেন ওদের জন্য ১০টি দুব্বা এনেছে, আমাদের একটি বা অর্ধেক দিয়েছিল।
মুসলিম হওয়ায় জলদস্যুরা কিছুটা নমনীয় ছিল। এমন ধারণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যারা জুলুম করে ওদের কাছে ধর্মকর্ম আর কী! আমরা ২৩ জন মুসলিম ছিলাম। আমরা রোজা অবস্থায় ছিলাম। এতে তারা একটু সফট ছিল বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছিল।
জিম্মিদশার প্রথম দিন ইফতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের কুককে একটু সুযোগ দিয়েছিল ইফতার রেডি করার জন্য।
এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের মুক্ত ২৩ নাবিক
জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার মো. আতিক উল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এএসএম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ, এবি পদের মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসাইন, জয় মাহমুদ, ওএস পদের মো. নাজমুল হক, অয়েলার পদের আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশাররফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম, জিএস পদের মোহাম্মদ নুর উদ্দিন ও ফিটার মোহাম্মদ সালেহ আহমদ।
মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ সোমালিয়ার দস্যুরা ২৩ নাবিকসহ এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি জিম্মি করেছিল। দেশটির উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগর থেকে জাহাজটি জিম্মি করেছিল সশস্ত্র জলদস্যুরা। ১৪ এপ্রিল ভোররাতে জাহাজটি জলদস্যুমুক্ত হয়। এ সময় ৬৫ জন জলদস্যু জাহাজটি থেকে বোটে নেমে যায়। পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুইটি যুদ্ধ জাহাজের পাহারায় এমভি আব্দুল্লাহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পার হয়। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে তখন জাহাজের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া, ডেকে হাই প্রেসার ফায়ার হোস বসানো হয়, যাতে জলদস্যুরা ফের হামলা করলে উচ্চচাপে পানি ছিটানো যায়।
গত ২২ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে জাহাজটি দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরের জেটিতে ভিড়েছিল। কয়লা খালাস শেষে ২৭ এপ্রিল স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নতুন ট্রিপের পণ্য লোড করতে ইউএইর মিনা সাকার (Mina Saqr) বন্দরে যায়। সেখান থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল এমভি আব্দুল্লাহ।
মঙ্গলবার (১৪ মে) দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ২৩ নাবিক কুতুবদিয়া বহির্নোঙরে অবস্থানরত এমভি আবদুল্লাহ থেকে ‘এমভি জাহান মনি ৩’ নামের লাইটার জাহাজে উঠেন। বিকেল চারটার দিকে তারা চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-১ জেটিতে আসেন। সেখানে স্বজনদের দেখে তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাদের চোখে ছিল পানি, মুখে হাসি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জেটিতেই তাদের বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়।