নিজস্ব প্রতিবেদক:
ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগব্যাধি আমাদের পেয়ে বসেছে। হঠাত্ করে কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হার্ড বিকল হচ্ছে, ফুসফুস ঝাঁজরা হয়ে যাচ্ছে। ভেজাল আর বিষাক্ত খাবার খেয়ে ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়ছি আমরা।
বর্তমানে সার্বিকভাবে রোগী বেড়েছে; রোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বেড়েছে হাসপাতালও। আমার পরিবারের কষ্টের কথাটাই আগে বলি—ক্যানসারে মারা গেছেন চাচা-চাচি, মামা, শ্বশুর আর ফুফাতো ভাই। অচেনা রোগে বাবাকে হারিয়েছি বছর দুই আগে। মা অসুস্থ হয়ে এখন বিছানায়। পাঁচ বছর আগে ভাইয়ের একটা কিডনি ফেলে দিতে হয়েছে; আরেকটাতে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। মায়ের মতো বড় বোনটা বেশ ভালোই ছিলেন এত দিন। হঠাত্ শুনি তার ফুসফুসের এমন অবস্থা যে চিকিত্সকের ভাষায় সেটা নাকি ঝাঁজরা হয়ে আছে, তার হর্টের অবস্থা প্রায় যায় যায়, কিডনিও শেষ পর্যায়ে। এ দেশের অসংখ্য পরিবারে আমার মতো এমন কষ্টের অনেক গল্প আছে।
প্রতিনিয়তই খাবারের সঙ্গে বিষ আমাদের পেটে ঢুকছে। আমরা খাবার খাব আর সেই খাবার হবে বিশুদ্ধ; বিশুদ্ধ খাবার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। এটা তো আমাদের অধিকার। আমরা কি বিশুদ্ধ খাবার পাচ্ছি? মাছে, ভাতে, আমে, জামে—কোথায় নেই বিষ? আমরা ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করে জেনেশুনে বিষ পান করছি। খাদ্যে ভেজালের শাস্তি ৭ থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড। কত জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে? তাই ভেজাল কারবারিরা ভেজাল মেশাতে সাহস পাচ্ছে। উন্নত দেশের কথা বাদই দিলাম, আমাদের পাশের দেশ ভারত, ভুটানেও ভোক্তা অধিকার আইন খুবই কর্যকর। এসব দেশে খাদ্যে ভেজাল প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। আর ভেজাল পণ্য বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্য প্রতিরোথে কঠোর আইন আছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দায়িত্বশীল নয়। তারা নিয়মিত ফলোআপ করে না। অবশ্য লোক দেখানো অভিযান চলে মাঝেমধ্যে। কেউ ধরা পড়লে আইনের ফাঁকফোকরে আবার বেরিয়ে যায় বা জরিমানা দিয়ে মাফ পেয়ে যায়।
ভেজাল খাদ্যের বিষ অনেক ক্ষেত্রে আমাদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কেবল হাসপাতালগুলোতে গেলেই বোঝা যায় কত ধরনের রোগই না এখন মানবদেহে বাসা বেঁধেছে। তরতাজা মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছি বাসায়। সেই মাছে হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিকসহ নানা ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে। মাংস কিনছি—সেটা গরু, ছাগল কিংবা মুরগি—সবকিছুই এখন মোটাতাজা করতে গিয়ে নানা ক্ষতিকর উপাদান তাতে যুক্ত হচ্ছে। দেশি মোরগ-মুরগির নামে বাজার থেকে যা কিনছি, তা-ও দ্রুত বড় করতে এবং ওজন বাড়াতে অ্যান্টিবায়োটিকসহ ক্ষতিকর খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। চাল কিনছি, তা-ও আবার বিষাক্ত ক্রোমিয়ামযুক্ত। একটু স্বাদের জন্য চিকন চাল খাব, তা মোটা চাল কেটে কেটে চিকন করে আমাদের খাওয়ানো হচ্ছে। শিক্ষিত মানুষ জানেন সেই খবর। তার পরও খাচ্ছেন। ফল খাব? সেখানেও কোনো না কোনো বিষ মেশানো। এসব খেয়ে রোগাক্রান্ত হব আর ওষুধ কিনে খাব, সেখানেও বিপত্তি। কেননা, এখন সেই ওষুধও ভেজাল। ভেজাল ওষুধ গ্রাহককের প্রেসকিপশনে লেখার জন্য ডাক্তারকে ফ্রিজ-এসি, টেলিভিশন প্রভৃতি ঘুষ দেওয়া হচ্ছে। অতএব, আমরা যাব কোথায়?
এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্বদ্ধ খাবার কি এভাবে দুষ্প্রাপ্য হতেই থাকবে? তেল, মসলা, লবণ, মুড়ি, চিনি, মাছ, দুধ, ফলমূল, সবজি, গুঁড়ো দুধ, কেশতেল, কসমেটিকস—সর্বত্রই ভেজালের ছড়াছড়ি। ফলের জুস, কোমল পানীয়—এসবের বেশির ভাগই কৃত্রিম কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফল প্রথমে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়, পরে ফরমালিন দিয়ে প্রিজার্ভ করা হয়। এতে দ্বিগুণ ক্ষতি। অসাধু ব্যবসায়ীরা খাবারের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য বিরিয়ানি, জিলাপি, জুস, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবারে সস্তা দামের টেক্সটাইল গ্রেড বিষাক্ত রং ব্যবহার করে থাকে, যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রত্যেক মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। এ দেশের মানবরূপী কিছু দানব বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাবারপ্রাপ্তি কঠিন করে ফেলছে। আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়া হলে দেশে ভেজাল-সন্ত্রাস কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না। সরকারকে ভেজাল খাদ্য রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্ট্রিট ফুড থেকে শুরু করে হোটেল-রেস্টুরেন্ট সর্বত্র ভেজালমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রচলন করতে হবে। এই জাতিকে বাঁচাতে ও সুস্থ-সবল রাখতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই গ্রহণ করতে হবে।
ভেজাল কারবারিরা ইতিমধ্যে ২ কোটি মানুষকে কেবল কিডনি রোগে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে অবলীলায়। এর মধ্যে প্রায় ৫০-৬০ হাজার লোক ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে জীবন ধারণ করছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজার। এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। ক্যানসারসহ কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত আরো ২ কোটি মানুষ। কেবল ক্যানসারের কারণে বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত ২৭৩ জনের মৃত্যু হয়। তাই ভেজাল খাবার যে করেই হোক প্রতিরোধ করতে হবে।
কেমিক্যাল একটি সংরক্ষিত ক্ষতিকর পদার্থ, যা সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে অতি সাবধানতায় বিশেষ বিশেষ কাজে ব্যবহূত হয়। কিন্তু অধুনা সর্বত্র এর যথেচ্ছ ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে এটা লবণের মতো অতি সস্তা, সহজলভ্য এবং ব্যবহারযোগ্য। আর এসব কেমিক্যাল শোনো ভেজাল খাবার খাচ্ছি আমরা। ফরমালিনসহ খাবারে ব্যবহূত ক্ষতিকারক ক্যামিক্যাল বিভিন্ন কাজে লাগে। ক্ষেত্রবিশেষে এটা দরকারিও। তাই আমদানি একেবারে নিষিদ্ধ করার উপায় নেই। তবে আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমদানিকারক ও ক্রেতাদের ওপর নজরদারি রাখতে হবে। দেশে ল্যাবে পরীক্ষা করার সুযোগ থাকলেও শিশুখাদ্যের অন্যতম উপাদান দুধে ফরমালিন মেশানোর বিষয়টিতে এখনো গুরুত্ব দেয়নি বিএসটিআই। এছাড়া সিটি করপোরেশন আমলে না নেওয়ায় নগরীর ছোট-বড় অধিকাংশই দুগ্ধজাত প্রতিষ্ঠানে অবাধে ভেজাল ও বিষাক্ত উপাদানযুক্ত খাবার বিক্রি হচ্ছে।
কোনো কোনো বছর রমজানের সময় মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বিক্রেতা ও উত্পাদনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে বিষাক্ত খাদ্যের ছোবল থেকে দেশকে বাঁচাতে সারা বছর ধরে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নামিদামি হোটেল, চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, রেস্তোরাঁ ও ফাস্টফুডের দোকানদারেরা যাতে এ ধরনের ভেজালযুক্ত খাদ্য বিক্রি করতে না পারে। সর্বোপরি নাগরিক হিসেবে আমাদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমাদের সচেতনতার কারণেও স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রচলন বাড়তে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও সমাজ বিশ্লেষক