সাইফুল হোসেন
আমরা সবাই জানি ঋণমুক্ত জীবন, প্রজাপতির জীবন। কিন্তু ঋণ থেকে বেরিয়ে আসা তো খুব সহজ নয়। ঋণমুক্ত জীবনযাপন বলা যতটা সহজ বিষয়টা আসলে ততটা সহজ নয়। আপনার চারপাশে তাকিয়ে দেখবেন, আত্মীয়-সজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই ঋণে ডুবে না থাকলেও অল্পবিস্তর ঋণগ্রস্ত প্রায় সবাই। কিন্তু ঋণ থেকে আসলে বেরিয়ে আসতে হবে, কারণ ঋণ বিশেষ করে মন্দ ঋণ থেকে যদি বের হয়ে আসা না যায় তাহলে আর্থিক স্বাধীনতার পথের যাত্রাপথটা দুরূহ হবে।
সেজন্যে আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করে আমাদেরকে ধীরে ধীরে ঋণ কমিয়ে এনে একসময় সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমরা জানি ভালো ও মন্দ এই দুই ধরনের ঋণ আছে এবং ভালো ঋণ মোটেও খারাপ নয়। মন্দ ঋণ আবার ভালো নয়। এজন্য মন্দ ঋণ বেরিয়ে আসতে হবে। ভালো ঋণ যদি থাকে সেটা সমস্যা নয়। তবে আমাদের জানতে হবে মন্দ ঋণ থেকে কিভাবে দ্রুত বের হয়ে আসা যায়।
আমাদের সবার উচিত দ্রুততার সহিত ঋণ পরিশোধ করা। ঋণবিহীন একটি জীবন কাটানো সহজ নয়, বিশেষ করে মন্দ ঋণবিহীন। কিন্তু মন্দ ঋণ থেকে বের হবার উপায়টা কি সেটা যদি আপনি চিন্তা করেন তাহলে দেখবেন, আপনার মধ্যে এই সমস্যার সমাধানটা আছে। কারণ ঋণ আপনার হয়ে অন্য কেউ পরিশোধ করে দিবে না। আপনার ঋণ আপনাকেই পরিশোধ করতে হবে।
ঋণমুক্ত কোনো মানুষ কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতায় ভোগেন খুব কম। তাই চলুন আমরা চেষ্টা করি, ঋণমুক্ত থাকতে, সুখী জীবনযাপন করতে। বাড়তি চাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে, সুস্থ থাকতে। হয়তো এক দিনে বা এক বছরে আমরা পারবো না, তবে তাড়াতাড়ি আমরা পারবো। চলুন চেষ্টা করে দেখি, সুন্দর, সুখী মন্দ ঋণমুক্ত একটা জীবন পাই কিনা। আমি জানি চেষ্টা করলেই পারা যাবে।
ঋণ পরিশোধ করার জন্যে নিজের আয় হয়তো বাড়াতে হবে না হলে খরচ কমিয়ে বেশি করে টাকা সঞ্চয় করতে হবে। আমি আপনাদেরকে কিছু পথ বাতলে দিচ্ছি যে কিভাবে আপনি সেই কঠিন কাজটাকে সহজে করতে পারবেন। আমার এই পরামর্শ আপনাদের ভাবনাকে শানিত করবে এবং ঋণ পরিশোধের দিকে যেতে আপনাকে উদ্বুদ্ধ করবে।
প্রথমে দেখুন, আপনার কোনো সঞ্চয় আছে কিনা। আমি বলতে চাচ্ছি আপনার সঞ্চয় একাউন্টে বিশেষ কোনো টাকা আছে কিনা আপনি দেখুন। কারণ একাউন্টে যদি আপনি টাকা রাখেন সেই টাকার বিপরীতে আপনি দুই তিন শতাংশের বেশি সুদ অথবা লভ্যাংশ পাবেন না। কিন্তু আপনার যে ঋণ আছে সেই ঋণের বিপরীতে আপনি যে সুদ দিচ্ছেন সেটা কিন্তু অনেক বেশি- দশ, এগারো, এমনকি বারো, তেরো পার্সেন্ট পর্যন্ত। আর ক্রেডিট কার্ডের ঋণ যদি হয় তাহলে তো এটা আরো অনেক বেশি।
যদি সঞ্চয় একাউন্টে টাকা থাকে তাহলে সেই টাকা দিয়ে আপনি ঋণ দ্রুত পরিশোধ করতে পারেন। তবে ভুলেও যে টাকা ইমারজেন্সি ফান্ডে রেখেছেন, যেটা গঠন করেছেন ছয় মাস থেকে এক বছর বা দুই বছর পর্যন্ত বিপদে খরচ চালানোর জন্য সেই ইমারজেন্সি ফান্ডে আপনি হাত দিবেন না। এই ইমার্জেন্সি ফান্ডের টাকা নিয়ে কিন্তু আপনি এই ঋণ পরিশোধ করবেন না।
আবার বলছি আপনার যদি ইমারজেন্সি ফান্ডের বাইরে কোনো সঞ্চয় থেকে থাকে যে টাকাটা এখনো বিনিয়োগ করেননি, সেই টাকা দিয়ে আপনি দেনার একটা অংশ পরিশোধ করতে পারেন। তাছাড়া ঋণ পরিশোধ করার জন্য আপনার অতিরিক্ত আয় করতে হতে পারে। চেষ্টা করে আপনি আয়ের একটি নতুন পথ খুলতে পারেন। কিন্তু চাইলেই আপনার আয় আপনি বাড়াতে পারবেন না।
আপনার যে দক্ষতা আছে সেটিকে কাজে লাগিয়ে, আপনি এখন যে ইনকাম করছেন তার সাথে আরো একটু বাড়তি ইনকাম করা যায় কিনা সেদিকে আপনার নজর দিতে হবে। এটা হতে পারে কোনো কমিশন বা বইয়ের কোনো রয়ালিটি বা আউটসোর্সিঙের কোনো আয় ইত্যাদি। আবার আপনি কোনো বোনাস বা উপহার পেলে সেই টাকাও ঋণ পরিশোধ করতে ব্যবহার করতে পারেন।
আমাদের প্রবণতা হচ্ছে, যদি বেতনের বাইরে কোনো টাকা আমরা পাই আমরা সেই টাকা খরচের প্লান করে ফেলি। আমার কথা হচ্ছে যতদিন আপনার ঋণ পরিশোধ না হচ্ছে, ততদিন খরচের লাগামটা একটু টেনে ধরতে শিখুন এবং ঋণ পরিশোধে যত্নশীল হন।
এরপর আপনি দেখেন যে, আপনার কোনো বিনিয়োগে বেশি লাভ যোগ হয়েছে কিনা। যদি থাকে, যেমন ধরুন, একটি স্টক কিনেছেন দশ টাকায়, কিন্তু সেটা এখন হয়ে গেছে বিশ টাকা বা পঁচিশ টাকা, তাহলে সেখান থেকে আপনি কিছু স্টক বিক্রি করে, লাভের টাকা দিয়ে আপনি কিছু ঋণ সমন্বয় করতে পারেন।
আপনি আরেকটা কাজ করতে পারেন, আপনার ইন্সুরেন্সের দিকে নজর দিতে পারেন। যেমন ধরুন, আপনার লাইফ ইন্সুরেন্স হয়তো আছে, বাচ্চাদের এডুকেশানের ওপরে ইন্সুরেন্স আছে। আরো বিভিন্ন ধরনের ইন্সুরেন্স আছে। যদি বিভিন্ন ধরনের ইন্সুরেন্স থেকে থাকে তাহলে লাইফ ইন্সুরেন্স বাদে আর বাকি যে ইন্সুরেন্সগুলো আছে ওইগুলো ভেঙে আপনি ঋণ সমন্বয় করতে পারেন।
তারপর যদি উত্তরাধিকার সূত্রে আপনি কোনো সম্পত্তি পেয়ে থাকেন, তাহলে আপনি অ্যানালাইসিস করে দেখেন যে, আপনি কি পেলেন। যেটা আপনি পেলেন সেটা খরচ না করে আপনি ঋণ পরিশোধে ব্যয় করেন। মন্দঋণ থেকে যত তাড়াতাড়ি বের হতে পারবেন তত তাড়াতাড়ি আপনি অ্যাসেট বিল্ড অ্যাপের দিকে মনোযোগ দিতে পারবেন।
আর একটি বিষয় দেখা যেতে পারে। আপনার যে পিএফ আছে তার বিপরীতে ঋণ নিয়ে আপনার ঋণ সমন্বয় করতে পারেন। বেশি সুদে যে ঋণটা আপনার আছে সেটাই প্রথমে সমন্বয় করতে পারেন। একটা ঋণ করে আমি আর একটা জিনিস সমন্বয় করতে বলছি এটার কারণ হচ্ছে পিএফ-এর বিপরীতে যে ঋণ সেই ঋণের সুদের হার অনেক কম। আর আপনার যে ঋণ তার সুদের হার অনেক বেশি।
মূলত আপনি দুটোর মধ্যে একটি তুলনা করে দেখেন, আপনি লাভবান হচ্ছেন। মূল কথা হচ্ছে, আপনি মন্দ ঋণের বিপরীতে যুদ্ধ ঘোষণা করুন। তার অর্থ হচ্ছে যে, আপনি মন্দ ঋণ থেকে যত তাড়াতাড়ি পারেন, নিজেকে মুক্ত করুন। কারণ মন্দ ঋণ আপনাকে আস্তে আস্তে ঋণের গহ্বরে ডুবিয়ে দিতে থাকে। বিশেষ করে ক্রেডিট কার্ডের ঋণ, পারসন্যাল ঋণ বা ভোক্তা ঋণসহ সমস্ত মন্দ ঋণ যা আপনার পকেট থেকে সুদসহ অনেক টাকা বের করে দেয়, সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে।
আপনি সিদ্ধান্ত নিন যে, আজ থেকে আপনি আর ঋণের দাসত্ব করবেন না। বরং তাড়াতাড়ি ঋণমুক্ত হয়ে বিনিয়োগের দিকে আপনি মনোযোগ দিবেন, নিজের অ্যাসেট বৃদ্ধি করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবেন। একবার ঋণমুক্ত হতে পারলে দেখবেন খুব আরাম লাগছে, দুশ্চিন্তাহীন লাগছে। সবাই তখন আপনার বন্ধু হয় যাচ্ছে। আর আপনার হাতে তখন টাকা থাকছে। তখন কারো কাছে আপনি আর হাত পাতছেন না। আপনি একটা সুন্দর জীবনযাপন করছেন।
আমার এক প্রতিবেশি ভদ্রলোকের একটি গল্প আপনাদের বলছি। তিনি অনেক সম্পত্তির মালিক, তার নিজস্ব বাড়ি গাড়ি সব আছে। তিনি আগে ব্যবসা করতেন এখন আর তেমন কিছু করেন না। ভাড়া থেকেই তাঁর আয় মূলত। উনি ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলেন মাত্র বিশ লাখ টাকা। সংসারে খরচ বেড়েছে, আয় কমেছে। ঋণের কিস্তি দিতে তার হিমশিম খেতে হয় প্রতিমাসে। ব্যাংক তাকে বারবার চিঠি দেয় এবং বারবার উনি চাইলেও টাকা পরিশোধ করতে পারেন না। ফলে ব্যাংক বাসায় লোক পাঠায়।
বাসার অন্য বাসিন্দারা সব জেনেও যান এবং দারোয়ানরাও জানেন যে উনি ঋণগ্রস্থ। উনি মাঝে মাঝে ঋণের ভয়ে পালিয়ে বেড়ান। বাসায় থাকলে উনি ওনার বাচ্চাদের বলেন, ব্যাংকের লোককে বলতে, যে উনি বাসায় নেই।
ভদ্রলোক এক প্রকার অসুস্থ হয়ে গেছেন। তাঁর হাই প্রেসার আছে সাথে ডায়াবেটিস। কি অসহায় অবস্থা একটু ভাবুন। উনি টাকা শোধ করতে না পারলে ব্যাংক কোর্টে যাবে টাকা আদায়ের জন্যে। যারা মন্দ ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে গেছেন তাদের এই অবস্থা হরহামেশাই।
আপনি যখন কারো কাছে ঋণী থাকেন তখন আপনার মন থাকে আসলে খুব ছোট। পাওনাদার সামনে এলে আপনি অসহায় বোধ করতে থাকেন। আপনি সবসময় চেইলেও কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না। আপনি ঋণী থাকলে মানুষের সাথে আপনার সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। আর যারা ঋণ মুক্ত, তাদের চেহারা থাকে অন্যরকম, দীপ্তিময়। তারা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারেন। তারা মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারেন। তারা রাতে আরাম করে ঘুমাতে পারেন।
যারা ঋণ থেকে দূরে থেকেছেন তারা লম্বা জীবন পেয়েছেন। ঋণ পরিশধের চাপ খুব ভয়ংকর। আপনারা জেনে থাকবেন, অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
ঋণমুক্ত কোনো মানুষ কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতায় ভোগেন খুব কম। তাই চলুন আমরা চেষ্টা করি, ঋণমুক্ত থাকতে, সুখী জীবনযাপন করতে। বাড়তি চাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে, সুস্থ থাকতে। হয়তো এক দিনে বা এক বছরে আমরা পারবো না, তবে তাড়াতাড়ি আমরা পারবো। চলুন চেষ্টা করে দেখি, সুন্দর, সুখী মন্দ ঋণমুক্ত একটা জীবন পাই কিনা। আমি জানি চেষ্টা করলেই পারা যাবে।
লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।