নিজস্ব প্রতিবেদক,বরিশাল:
তৃণমূল নেতারা বলছেন, দুই নেতার বিরোধে দুপক্ষের অনুসারীরা দীর্ঘদিন ধরেই বিভক্ত। তাদের দ্বন্দ্বের নেপথ্যে রয়েছে চর ও মাছ ঘাট, খেয়াঘাট, নদীতে মাছ শিকারের নিয়ন্ত্রণ।
পত্রিকার পাতা খুললে বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলায় সংঘর্ষ, হামলা, দখল, ভাঙচুর ও লুটপাটের খবর দেখ যায় প্রায়ই। তবে সম্প্রতি হিজলায় জামাল মাঝি নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই নেতার পুরনো বিরোধকে নতুন করে সামনে এনেছে।
ধুলখোলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জামাল ছিলেন হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ নিয়ে গঠিত বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের অনুসারী। পঙ্কজ সমর্থকরা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করছে সংরক্ষিত আসনের এমপি শাম্মী আহম্মেদের অনুসারীদের। শাম্মীর অনুসারীরা তা অস্বীকার করছেন।
এলাকার আধিপত্য নিয়ে পঙ্কজ ও শাম্মীর বিরোধ নতুন কিছু নয়। ক্ষমতার এই লড়াইয়ে শাম্মীর পাশে রয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। পিছিয়ে নেই পঙ্কজও; মাঠে তার অবস্থান বেশ পোক্ত।
দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া পঙ্কজ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মেহেন্দিগঞ্জ-হিজলার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী বরিশালের এ আসন থেকে দলের মনোনয়ন পেয়েও দ্বৈত নাগরিকত্বের জটিলতায় ভোট থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। কিন্তু দল তাকে সংরক্ষিত আসনের এমপি করে নিয়েছে।
এরপর থেকে আবারও মুখোমুখি দুই উপজেলার ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা বলছেন, দুই নেতার বিরোধে দুপক্ষের অনুসারীরা দীর্ঘদিন ধরেই বিভক্ত। তাদের দ্বন্দ্বের নেপথ্যে রয়েছে চর ও মাছ ঘাট, খেয়াঘাট, নদীতে মাছ শিকারের নিয়ন্ত্রণ। এই দ্বন্দ্বের কারণে ভুগছে সাধারণ মানুষ; দলেরও ক্ষতি হচ্ছে।
মাসের পর মাস ধরে এই বিরোধের বলী হয়েছেন ডজনখানেক নেতাকর্মী। হামলা-সংঘর্ষে পঙ্গু হয়েছেন অনেকে। সেসব ঘটনায় মামলা-পাল্টা মামলায় আসামি হয়ে অনেকে কারাগারে আছেন, অনেক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যারা এর শিকার হচ্ছেন তাদের জীবন-জীবিকা থমকে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এ মানুষরা এখন এলাকায় শান্তি চান।
হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার তিনটি থানা নিয়ে বরিশাল-৪ আসন গঠিত। তিন থানা হল- হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ ও কাজিরহাট। মেহেন্দিগঞ্জ পৌরসভাসহ দুই উপজেলার মোট ২২টি ইউনিয়ন রয়েছে এ আসনে। হিজলা থানার ওসি জুবাইর আহম্মেদ জানান, দুই পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে হামলা-সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত থানায় ১৫/২০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় তিন থেকে চারশ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ আসামি।
জামাল মাঝি হত্যার পর আতঙ্কে রয়েছেন হিজলা উপজেলার ধূলখোলা ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ।আর মেহেন্দিঞ্জ থানার ওসি ইয়াসিনুল হক বলছেন, তার থানায় মামলা কম; দুই-তিনটি। তবে প্রতিদিনই কেউ না কেউ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে থানায় হাজির হন।
কাজিরহাট থানার ওসি মো. শাহবুদ্দিন বলেন, তার থানায় কয়টি মামলা রয়েছে, কাগজপত্র না দেখে বলা যাবে না। তবে এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে ‘একটু ভালো’।
বরিশাল-৪ আসন একটা সময় বিএনপির ঘাঁটি ছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেখানে প্রতিটি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পঙ্কজ নাথ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একাদশ নির্বাচনেও এ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন দলীয় মনোনয়নে।
মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “এমপি পঙ্কজের দ্বন্দ্ব মূলত শাম্মীর সঙ্গে নয়। তার দ্বন্দ্ব হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ টিপু সিকদার এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র কামালউদ্দিন খানের সঙ্গে। ওই দুই নেতা শাম্মীকে ‘ব্যবহার করে’ নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেন।”
হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, “এমপি পঙ্কজ নাথ বলেছিলেন, তার মনোনয়ন দলীয় সভানেত্রীর হাতেও নেই। এ ধরনের একটি মন্তব্য করে দলীয় সভানেত্রীর বিরাগভাজন হন তিনি। যার কারণে ২০১৯ সালের অক্টোবরে তাকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে নিষ্ক্রিয় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।”
মেহেন্দিগঞ্জ ও হিজলার এই দুই নেতার দাবি, ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই উপজেলাতে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সমর্থকরা নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পায়।
কিন্তু অনেক আওয়ামী লীগ নেতা নৌকার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়ে আসেন। সেসব স্বতন্ত্র প্রার্থীরা স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমর্থন পেয়েছেন। এ ঘটনায় জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে পঙ্কজের দূরত্বের সৃষ্টি করে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সংসদ সদস্য পঙ্কজ এবং এক পুলিশ কর্মকর্তার একটি অডিও ভাইরাল হয়। সেখানে মেহেন্দিগঞ্জ পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল খানকে কোপানোর নির্দেশ দেওয়ার কথা শোনা যায়।
ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি পঙ্কজকে দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। ওই ঘটনায় শাম্মীকে দায়ী করেন পঙ্কজ; এরপর থেকে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
ধূলখোলা ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামের এই মেঘনার তীরে পড়ে ছিল জামাল মাঝির লাশ। স্থানীয়রা বলছেন, দল থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর থেকে পঙ্কজ-অনুসারীরা কিছুটা ‘নীরব’ হয়ে যান। তখন দুই উপজেলায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের অনুসারীরা। পরে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের অনুসারীরা শাম্মীর অনুসারী হয়ে দুই উপজেলায় প্রভাব বিস্তার শুরু করেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দুইবারের দলীয় মনোনয়নে সংসদ পঙ্কজ নাথকে বাদ দিয়ে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় শাম্মীকে। এরপর একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েন পঙ্কজ। দুই উপজেলা একচ্ছত্র আধিপত্য শুরু করে শাম্মীর অনুসারীরা। এর মধ্যেই সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দেন পঙ্কজ নাথ।
দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে প্রার্থিতা বাতিল হলে শাম্মীর অনুসারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ‘প্রায় ফাঁকা মাঠ’ পেয়ে যান স্বতন্ত্র প্রার্থী পঙ্কজ। তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপরই দুই উপজেলায় ‘পুরনো প্রভাব বিস্তারে’ সক্রিয় হয়ে উঠেন পঙ্কজ অনুসারী আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এর মধ্যে শাম্মী আহম্মেদও সংরক্ষিত সংসদ সদস্য হন। তখন তার অনুসারীরাও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ‘সক্রিয়’ হতে শুরু করেন। এ নিয়ে দুই উপজেলায় হামলা-পাল্টা হামলা ও সংঘর্ষের শুরু হয়।
এরই মধ্যে ১৬ মার্চ ধূলখোলা ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা জামাল মাঝি হত্যাকাণ্ড ঘটে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, দুই নেতার দ্বন্দ্বের কারণে ভোগান্তিতে থাকতে হয় তাদের। সাধারণ মানুষ ঠিকমত তাদের পেশাগত কাজও করতে পারছেন না।
সম্প্রতি হিজলা উপজেলার ধূলখোলা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, সেখানে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন। মেঘনা নদীর তীরের পালপাড়া গ্রামে প্রবেশের মুখে অর্ধশতাধিক নৌকা এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে। কিছু দূর এগোতে চোখে পড়ে একটি আগুনে পোড়া ঘরের ভিটি; পাশেই পড়ে আছে পোড়া টিন। তখন গ্রামের কয়েকজন নারীকে শুধু দেখা গেল। তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সবাই বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েন।
মো. মিজান নামের এক স্থানীয় সাংবাদিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ২ মার্চ থেকে পালপাড়া গ্রামে দুই অনুসারীদের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। পোড়া ঘরটি হত্যার শিকার আওয়ামী লীগ নেতা জামাল মাঝির। তাকে হত্যার আগে তার ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। “ঘর বাইরে থেকে আটকে পরিবারের সকলকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ঘটনার পর গ্রামে কোনো পুরুষ নেই; সবাই পালিয়ে গেছে। দুই পক্ষ নিয়ে কোনো মানুষ কথা বলবে না।”
ধূলখোলা ইউনিয়নের মাঝের চর গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী মো. জসিম বলেন, “দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের কারণে তৃণমূল নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হত্যার ঘটনার পর থেকে সবাই আতঙ্কে।
“কাকে গ্রেপ্তার করে, প্রশাসন এসে কী জিজ্ঞেস করে? কী বলবো, কার বিরুদ্ধে যাবে। এ কারণে সবাই দূরে সরে আছে।” ধূলখোলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এনামুল ইসলাম রাসেল বলেন, “দুই পক্ষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই, এমন লোক নাই। কেউ কইরা হয়েছে, কেউ না কইররাও হয়েছে।”
ধূলখোলা ইউনিয়নের বাতুয়া গ্রামের জেলারা এখনও মাছ ধরতে পারছেন না।ধূলখোলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম পঙ্কজের পক্ষে সুর তুলে বলেন, “মেহেন্দিগঞ্জের সলদি গ্রামের কিছু সন্ত্রাসী সব সময় ধূলখোলা ইউনিয়নে লুটপাট করে। পঙ্কজ দেবনাথ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এসব সন্ত্রাসীরা লুটপাট করতে পারেনি। শাম্মী আহম্মেদ সংরক্ষিত সংসদ সদস্য হওয়ার পর আবার লুটপাট শুরু হয়েছে।
“অন্য ইউনিয়নের লোক নিয়ে এসে দখল ও লুটপাট করার চেষ্টা করে ধুলখোলার ইউপি চেয়ারম্যান জামালউদ্দিন ঢালী। তার লুটপাটে বাধা দেওয়ায় জামাল মাঝিকে হত্যা করা হয়েছে।”
পঙ্কজের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ অনুসারী ও বর্তমানে শাম্মীর অনুসারী মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম ভুলু। তিনি সিএনএনবাংল২৪কে বলেন, “যখন পঙ্কজ নৌকার মনোনয়নে এমপি ছিলেন; তখন তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তিনি এখন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য। তাই আমি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যের পক্ষে রয়েছি। শুধু আমি না, উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সবাই শাম্মী এমপির পক্ষে রয়েছেন।”
তবে দুই এমপির দ্বন্দ্বে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে স্বীকার করেছেন ভুলু। দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
তবে এ দ্বন্দ্ব দুই উপজেলার কেউ মেটাতে পারবে না মন্তব্য করে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, “দ্বন্দ্ব মেটাতে পারবে শুধু বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।”
এমপি পঙ্কজের সঙ্গে আর্দশের মিল হয় না বলে, তার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ টিপুর। তবে কেউ কাউকে ছোট করে কথাও বলেন না বলে জানালেন।
পোড়া ঘরটি হত্যার শিকার আওয়ামী লীগ নেতা জামাল মাঝির। হত্যার আগে তার ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়ে জানতে চাইলে টিপু বলেন, “আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ঘটনা ঘটে। যারা করে তারাই ভোগে। আমি এসবের মধ্যে নেই।”
দ্বন্দ্ব নিরসন করা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যারা দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জড়িত; তাদের নিয়ে বসা উচিত। কী নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, তা জেনে সমাধান করলেই এসব বন্ধ হবে।”
হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বড়জালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন হাওলাদার সিএনএনবাংল২৪কে বলেন, “এটা স্বার্থের দ্বন্দ্ব; কে বড় নেতা- সেই নিয়েই লড়াই। এ নিয়ে হানাহানি লেগেই রয়েছে। এতে নেতাদের তো কিছু হয় না। মরে গরিব।
“এর থেকে বের হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য বড় নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে আরও বড় ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাবে।”
কাজীরহাট থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সঞ্জয় চন্দ্র বলছিলেন, “দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর তার নামে তিনটি মামলা হয়েছে। গ্রামে না থাকার পরেও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের নির্দেশে তার অনুসারীরা মামলা দিয়েছেন।
জামাল মাঝির মাছ ঘাট।সঞ্জয়ের অভিযোগ, “পঙ্কজ দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগ ধ্বংসের খেলায় মেতে রয়েছে। তার কারণে দুই উপজেলার তিন থানা এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
“ধূলখোলা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগে জামাল মাঝি নিজের ঘরে নিজে আগুন দিয়ে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানসহ শাম্মী অনুসারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। জামাল মাঝিকে হত্যা করে শাম্মী অনুসারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।”
যুক্তি তুলে ধরে সঞ্জয় বলেন, “হত্যা মামলায় চার ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে আসামি করা হয়েছে। এমনকি জেলে থাকা দুইজনকেও এ তালিকায় রাখা হয়েছে। যাদের আসামি করা হয়েছে, তারা সবাই শাম্মীর অনুসারী। এটা স্পষ্ট শাম্মীর অনুসারীদের ফাঁসানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে জামালকে হত্যা করা হয়েছে। যা পঙ্কজ নাথের পরিকল্পনায় হয়েছে।”
বরিশাল-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আফজালুল করিম। দুই নেতার দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে তিনি সিএনএনবাংল২৪কে বলেন, “স্বার্থ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ ঘটনা ঘটছে। এটা রাজনৈতিক কোনো দ্বন্দ্ব নয়। যা প্রতিরোধে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ ও সংরক্ষিত সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদ ব্যর্থ হয়েছেন। এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।”
পঙ্কজের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়ে প্রশ্ন করলে সংরক্ষিত আসনের এমপি শাম্মী আহম্মেদ সিএনএনবাংল২৪কে বলেন, “আওয়ামী লীগ থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যর সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সে যদি আওয়ামী লীগের কোনো নেতা হত, তাহলে তার সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টি আসত। সে তো আওয়ামী লীগের কেউ না।”
পঙ্কজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বলেন, “হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জের সাধারণ মানুষ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করছে পঙ্কজ নাথ। তার হাত থেকে রক্ষা পেতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আমার কাছে এসেছেন।”
‘জন্মগতভাবে’ আওয়ামী পরিবারের সন্তান হিসেবে আমৃত্যু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির কথা বলেন সংসদ সদস্য শাম্মী।
তিনি বলেন, “আমি তো এখানে এসেছি এক বছরও হয়নি। তার আগে যে ১৩ খুন হয়েছে। সেটা কার সঙ্গে দ্বন্দ্বে হয়েছে। সেই সব খুনের বিচার হয়েছে? হয়নি।”
“জামাল মাঝি হত্যার পর আমি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছি। কী কারণে খুন হয়েছে, কারা করেছে, সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসুক। আমি সেটা চাই। আমি তো কাউকে দোষ দিইনি। তদন্তনাধীন বিষয়টি নিয়ে কোনো কথাও বলতে যাইনি। কিন্তু তিনি কী করলেন, নাম ধরে বলে দিলেন। তদন্ত হওয়ার আগেই তিনি কীভাবে জানলেন? এ থেকেই স্পষ্ট, এসব হত্যাকাণ্ড কার পরিকল্পনায় হয়।”
শাম্মীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলে পঙ্কজ নাথ বলেন, “এ ধরনের ঘটনা তো আগে ঘটেনি। শাম্মী সংরক্ষিত সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।”
পঙ্কজের অভিযোগ, শাম্মী ‘সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়’ দেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের ‘কতিপয় নেতার’ পরামর্শে তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করতে গিয়ে এ সব ঘটনা ঘটিয়েছেন।
“এ সকল ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে শাম্মী ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের চুপ থাকতে হবে,” বলেন সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ।