বিশেষ প্রতিবেদক
সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাস্তবায়নে ডিসি-ইউএনওদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ২২ দফা নির্দেশনা।
সিনেমা হলগুলোতে শো শুরুর আগে ও মধ্যবিরতিতে পেনশন স্কিমের ভিডিও দেখাতে হবে।
মসজিদের খুতবা ও উপাসনালয়ের আলোচনায়ও পেনশন স্কিম নিয়ে বক্তব্য থাকতে হবে।
স্থানীয় কেব্ল টিভি নেটওয়ার্কে পেনশন স্কিম সম্পর্কে টিভি স্ক্রল দিতে হবে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নাগরিকদের সাড়া নেই। প্রত্যাশা অনুযায়ী জমা পড়ছে না চাঁদা। স্কিম চালুর ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ২৭ হাজার মানুষ হিসাব খুলেছেন। এ অবস্থায় পেনশন স্কিমে সর্বস্তরের জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার। এ জন্য জোর দেওয়া হচ্ছে প্রচারে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এরই মধ্যে ১৪টি নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এতে নানামুখী প্রচারের পাশাপাশি মসজিদ ও অন্যান্য উপাসনালয়েও পেনশন নিয়ে আলোচনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সরকারি চাকরিজীবীদের বাইরেও সর্বস্তরের জনগণকে পেনশন সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার জন্য গত বছরের ১৭ আগস্ট ঢাকঢোল পিটিয়ে সর্বজনীন পেনশন চালু করে সরকার। সেদিন প্রাথমিকভাবে চারটি স্কিম চালু করা হয়। পরে চালু করা হয় আরেকটি। স্কিমগুলো হলো–প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রত্যয়। ‘প্রবাস’ শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’। কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমারসহ স্বকর্মে নিয়োজিত মানুষের জন্য ‘সুরক্ষা’। আর ‘সমতা’ হলো নিম্ন আয়ের অসচ্ছল মানুষের জন্য। এসব স্কিমে আজীবন পেনশন-সুবিধা পেতে ন্যূনতম ১০ বছর নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হবে। তবে কেউ ১৮ বছর বয়স থেকে চাঁদা দিলে তাঁকে ৪২ বছর দিতে হবে। সর্বশেষ চালু করা স্কিম প্রত্যয় সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য।
চালু হওয়া স্কিমগুলোয় ১০ কোটি মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য নেয় জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সে অনুযায়ী সাড়া মিলছে না। স্কিম চালুর ছয় মাসে যত মানুষ হিসাব খুলেছে, তা লক্ষ্যের ১ শতাংশেরও কম। পেনশন স্কিমে মানুষের অংশগ্রহণ কম হওয়ায় চাঁদাও জমা পড়ছে কম। যদিও পেনশন তহবিলের চাঁদা থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। পেনশন স্কিমে চাঁদা কম জমা পড়ায় সেখান থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী টাকা পাচ্ছে না সরকার। জানা গেছে, গত অক্টোবরে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সর্বজনীন পেনশন তহবিলে জমা হওয়া ১১ কোটি ৩১ লাখ টাকা দিয়ে ট্রেজারি বন্ড কেনা হয়েছে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে এবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অংশ নিতে নির্দেশসর্বজনীন পেনশন স্কিমে এবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অংশ নিতে নির্দেশ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বজনীন পেনশন নিয়ে শুরুতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিলেও স্কিম চালুর পর সেই আগ্রহে ভাটা পড়ার মূল কারণ আস্থার সংকট। এ অবস্থায় মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরানোর জন্য দরকার ব্যাপক প্রচার ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি। সরকার এখন তা নিয়ে কাজ করছে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর ছয় মাস পূর্তি হয়েছে ১৭ মার্চ। এর পরদিন ১৮ মার্চ এক পরিপত্রে দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ২২ দফা নির্দেশনা দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, যার মধ্যে ১৪টিই ছিল পেনশন সম্পর্কে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ নিয়ে। বাকি নির্দেশনাগুলোর পাঁচটি নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ে এবং তিনটি ছিল মনিটরিং-সংক্রান্ত।
উদ্বুদ্ধকরণ-সংক্রান্ত নির্দেশনাগুলোয় পেনশন স্কিম সম্পর্কে সর্বাত্মক প্রচারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম সম্পর্কে জনগণকে সচেতন ও আগ্রহী করতে বিভিন্ন পর্যায়ে সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, উদ্বুদ্ধকরণ মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। হাটবাজার, গ্রোথ সেন্টার, গ্রামীণ মেলা প্রভৃতি জায়গায় জেলা ও উপজেলা তথ্য অফিসের মাধ্যমে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বিজ্ঞাপন, জিঙ্গেল, ভিডিও নিয়মিত প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে প্রয়োজনে সর্বজনীন পেনশন স্কিম সম্পর্কিত আলাদা ডেস্ক স্থাপন এবং বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দাপ্তরিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার কথাও বলা হয়েছে নির্দেশনায়।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম করমুক্তসর্বজনীন পেনশন স্কিম করমুক্ত পরিপত্রে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সর্বজনীন পেনশন স্কিম সম্পর্কে সচেতন করে তাদের মাধ্যমে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রচনা লিখন প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে হবে।
এ ছাড়া সর্বজনীন পেনশন স্কিম সম্পর্কে স্থানীয় কেব্ল টিভি নেটওয়ার্কে টিভি স্ক্রল প্রদর্শন, সিনেমা হলগুলোতে শো শুরু হওয়ার আগে এবং মধ্যবিরতিতে ভিডিও প্রদর্শনের নির্দেশনা দিতে বলা হয়েছে পরিপত্রে। একইভাবে দেশের মসজিদগুলোতে এখন থেকে জুমার খুতবায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম সম্পর্কে বয়ান এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়েও পুরোহিতদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সিএনএনবাংলঅ২৪কে বলেন, ‘ক্যাম্পেইন হিসাবে এই উদ্যোগ যথেষ্ট ব্যাপক ও সুচিন্তিত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই ক্যাম্পেইনকে মোটিভেশনে পরিণত করা, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার মনোভাব সৃষ্টি করা। সেই উদ্দেশ্যে এই ক্যাম্পেইনে তৃণমূল থেকে যে ফিডব্যাক পাওয়া যাবে, সেগুলো যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।’
সর্বজনীন পেনশন: কত টাকার মাসিক কিস্তিতে কত টাকা মিলবে সর্বজনীন পেনশন: কত টাকার মাসিক কিস্তিতে কত টাকা মিলবে শুধু প্রচার নয়, মানুষ যাতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে সহজে নিবন্ধিত হতে পারে, সে জন্য পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এতে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের নিবন্ধনের জন্য উপযুক্ত করে তোলা, সব ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকেই যেন জনগণ বিভিন্ন স্কিমে নিবন্ধন করতে পারে, তার সব ব্যবস্থা রাখা এবং ডাক বিভাগের ডিজিটাল পোস্ট অফিসের আউটলেটের মাধ্যমে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের নিবন্ধন কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
পরিপত্রে আরও বলা হয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোর শাখা ফ্রন্ট অফিস হিসেবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের নিবন্ধন ও অর্থ জমা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অর্থ জমা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় কোনো সমস্যার উদ্ভব হলে তা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে বিষয়টি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নিবন্ধন কার্যক্রম জোরদার করতে প্রয়োজনে সময়ে সময়ে বিশেষ ক্যাম্পেইন ও ভ্রাম্যমাণ বুথের মাধ্যমে নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। নিবন্ধন-সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতার উদ্ভব হলে তা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করতে হবে।
সর্বজনীন পেনশন বাধ্যতামূলক জুলাইয়ে, মূল বেতনের ১০ শতাংশ জমাসর্বজনীন পেনশন বাধ্যতামূলক জুলাইয়ে, মূল বেতনের ১০ শতাংশ জমা
পেনশন স্কিমের কার্যক্রম নজরদারির বিষয়েও তিন দফা নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এতে মাঠপর্যায়ে এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোথাও কোনো সমস্যা দেখা দিলে জাতীয় বাস্তবায়ন ও সমন্বয় কমিটির পরামর্শ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তারা যেন নিজস্ব সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনায় যথাপদ্ধতিতে সার্বিক মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ লক্ষ্যে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে যথোপযুক্ত ডিজিটাল পরিকাঠামো চালুসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।