ই-পেপার | রবিবার , ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে শুধুই মৌখিক পরীক্ষা নীতিমালায় লিখিত পরীক্ষার কথা থাকলেও মানা হচ্ছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক:

 

সরকারি কলেজগুলোতে পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি বড় প্রক্রিয়ার (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা) মধ্য দিয়ে নিয়োগ দিয়ে থাকে। প্রথমে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক বাছাই করা হয়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের কয়েক দিন ব্যাপী নেওয়া হয় লিখিত পরীক্ষা। সর্বশেষ মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডে যেসব শিক্ষক-কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন, তা অত্যন্ত গোপনীয় থাকে। ফলে এই নিয়োগে কোনো অনিয়মের কথা শোনা যায় না। অনিয়ম হওয়ার সুযোগও থাকে না।

 

অন্যদিকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য কোনো ধরনের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয় না। শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমেই বাছাই করা হয়। মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে কারা থাকবেন তা-ও নির্ধারিত, সব প্রার্থীরই তা জানা থাকে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের নিয়োগের জন্য প্রয়োজনে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলেছে। যদিও লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।

 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পরিচালক মো. জামিনুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি অভিন্ন নীতিমালা রয়েছে। যেখানে প্রার্থীদের ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই যোগ্যতার চেয়ে প্রয়োজনে বেশি যোগ্যতা নির্ধারণ করতে পারবে। কিন্তু কম নির্ধারণ করতে পারবে না। এই নীতিমালা শুধু শিক্ষক নিয়োগের জন্য। কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয় কিছু বলা হয়নি।

 

সম্প্রতি রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪ জন শিক্ষক ও ১৫ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগে কোনো পদেই লিখিত পরীক্ষা হয়নি। শুধু মৌখিক পরীক্ষা নিয়েই এদের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য এক বছর সময় নেওয়া হয়। তবে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় শুধু মৌখিক পরীক্ষা নিয়েই, এদের পুলিশ ভেরিফিকেশনও হয়নি। উপাচার্যের এক ছেলেকে কর্মকর্তা নিয়োগে নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়। এছাড়া বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীকে বাদ দিয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, লিখিত পরীক্ষা হলে অনিয়মের সুযোগ কমত।

 

২০২১ সালের ৫ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদিত ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নয়নের যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণের নির্দেশিকা’ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে ন্যূনতম যোগ্যতার পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কোনো বিভাগে প্রভাষক নিয়োগের জন্য প্রয়োজনে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে একটি শর্টলিস্ট প্রস্তুত করে সাক্ষাত্কারের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবেন।’ এখানে ‘প্রয়োজনে’ শব্দটি যুক্ত করে এই লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাই তুলে ধরা হয়েছে।

 

জসীম উদ্দিন নামে একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মনে করেন, এখানে প্রয়োজনে শব্দটি যুক্ত করে বাক্যটিতেই হালকা করে দেওয়া হয়েছে। যদি প্রয়োজন শব্দটি যুক্ত করা না হতো তাহলে সব বিশ্ববিদ্যালয় লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি বাধ্যবাধকতা মনে করত। যা শিক্ষক নিয়োগের জন্য সুফল বয়ে আনত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া না হলেও কর্মকর্তা নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, ‘আমরা যাদের শিক্ষক হিসেবে নিই, তাদের অধিকাংশই আমাদের শিক্ষার্থী। একটা মূল্যায়নের মধ্য দিয়েই তারা অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে। সেজন্যই শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষার প্র?্যাকটিস আমাদের নেই। শিক্ষক নিয়োগে শুধু ভাইভা নিয়ে থাকি। ভাইভার মাধ্যমে তার প্রেজেনটেশন দক্ষতা, ম্যানেজমেন্ট দক্ষতাগুলো আমরা যাচাই করে থাকি। লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে তাকে আমরা শুরু থেকেই যাচাই-বাছাই করে নিয়ে আসি।’

 

এই শিক্ষক মনে করেন, সামনে হয়তো আমাদের লিখিত পরীক্ষার দিকে যেতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগে গবেষণার শর্তটিও জুড়ে দেওয়া হতে পারে। কেননা গবেষণায় আগ্রহ না থাকলে এক জন শিক্ষক কখনো পরিপূর্ণ হতে পারেন না। শিক্ষকরা যাতে শুরু থেকেই গবেষণায় নিজেকে যুক্ত রাখেন, সেজন্য এই শর্তটি হয়তো সামনে জুড়ে দেওয়া হবে।

 

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কিউ এম মাহবুব বলেন, শিক্ষক নিয়োগে এখন মৌখিক পরীক্ষা হয়। ইউজিসির নিয়মে কোথাও বলা নেই ম্যান্ডেটরি লিখিত পরীক্ষা নিতে হবে। লিখিত পরীক্ষা নেওয়া যায়, কিন্তু এ প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। তবে সামনে আমরা লিখিত পরীক্ষা চালু করব। আমার কাছে তো তার সব রেকর্ড আছে, জিপিএ কত পেয়েছে, আর্টিকেল আছে কি না, ডিপার্টমেন্টে কে প্রথম, কে দ্বিতীয়, কোন বিশ্ববিদ্যালয়—এসব তো আমরা দেখছি। মৌখিক পরীক্ষায় চার-পাঁচ জন এক্সপার্ট মেম্বার (প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ডিন, চেয়ারম্যান) থাকেন তারা সবকিছু যাচাই-বাছাই করেন। কর্মকর্তা নিয়োগে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা হয়েছে, সবক্ষেত্রে নয়। সিট আছে দুুটি, আবেদন করেছে করছে ২০০ জন। তখন শুধু মৌখিক পরীক্ষা না নিয়ে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে তালিকা শর্ট করা হয়। এরপর মৌখিক হয়।

 

বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুল আলম বলেন, শিক্ষক নিয়োগে এখনো লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। তবে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া যায়।

রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন শিক্ষক জানিয়েছেন, আমি যদিও শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছি। তবুও আমি মনে করে ব্যাপক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া উচিত। মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হলে মেধা যাচাই করা সহজ হবে এবং অনিয়মের সুযোগ কমে আসবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক মনে করে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে যে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়, তা মূলত লোক দেখানো হয়। প্রার্থী আগেই নির্ধারণ হয়ে থাকে। উপাচার্য একক এক্তিয়ারেই এই নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।