ই-পেপার | শুক্রবার , ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণ : সমকালীন মতামত

মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ছিদ্দিকী :

 

মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করার পূর্বেই পৃথিবীকে তাদের বাসোপযোগী করে রেখেছেন, তাদের বাঁচার জন্য রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন। মানুষের বসবাস ও রিযিকের জন্য প্রধানত বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছালি ও উদ্ভিদরাজি প্রয়োজন। ধান, গম, ভুট্টা, যব, আখ, আম, জাম, কাঁঠাল, খেজুর প্রভৃতি শস্য ও ফল-ফলাদি হলো মানুষের খাদ্য। এ সবই উৎপন্ন হয় গাছ থেকে।

আল্লাহ তায়ালা শান্তির স্থান হিসেবে পবিত্র কুরআনের যেখানেই জান্নাতের বর্ণনা দিয়েছেন সেখানেই বৃক্ষরাজি, মনোরম উদ্যান ও বহমান ঝরনাধারার কথা বলেছেন। দুনিয়ায় মানুষের বাঁচার জন্যও তিনি এসবের ব্যবস্থা করেছেন। বলেছেন, তাদের জন্য একটি নিদর্শন মৃত পৃথিবী। আমি একে জীবিত করেছি এবং তা থেকে উৎপন্ন করেছি শস্য, তারা তা থেকে খায় (সূরা ইয়াসীন)। সূরা আর-রহমানে বর্ণনা করেছেন, তিনি পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্ট জীবের জন্য। এতে আছে ফলমূল এবং বহিরাবরণ বিশিষ্ট খেজুর বৃক্ষ, আর আছে খোসাবিশিষ্ট শস্য ও সুগন্ধি ফুল। সূরা আল আনয়ামে বলেছেন, তিনিই সেই সত্তা, যিনি নানা ধরনের গুল্মলতাবিশিষ্ট বাগবাগিচা ও নিজ কান্ডের উপর দাঁড়ানো ঘন সন্নিবিষ্ট বৃক্ষরাজি সৃষ্টি করেছেন, খেজুর গাছ ও ক্ষেতে ফসল ফলিয়েছেন যা থেকে বিভিন্ন রকম খাবার পাওয়া যায়।

আল্লাহ তায়ালা এভাবে অসংখ্য আয়াতে দুনিয়া ও জান্নাতের বৃক্ষরাজি, উদ্যান ও শস্যক্ষেতকে তাঁর নিয়ামত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এসব বৃক্ষ ও উদ্ভিদ মানুষকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধ, ছায়া ও কাঠ দেয়। বৃক্ষ কার্বন ডাই- অক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করে বাতাসকে বিষমুক্ত করে। আর ছাড়ে মানুষ। ও আল্লাহর কী সুন্দর ব্যবস্থা।

জীবকুলের বাঁচার বড় উপাদান অক্সিজেন। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি হেক্টর বনভূমি দৈনিক ৬৫০ কেজি অক্সিজেন বাতাসে ছাড়ে এবং একই সাথে ৯০০ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। একটি ফলবান বৃক্ষ যদি ৫০ বছর বাঁচে, তাহলে তার জীবদ্দশায় ফল, কাঠ, গোখাদ্য, অক্সিজেন প্রভৃতি আকারে যে অবদান রাখে তার অনুমিত আর্থিক মূল্য ২৩ লাখ টাকারও বেশি।

বৃক্ষ আরো একটি বড় উপকার করছে। তা পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখছে। আবহাওয়া সুশীতল রাখতে, ঝড়- ঝঞ্ঝা প্রতিরোধ করতে, বন্যা, ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস রোধে বৃক্ষরাজির ভূমিকা বিরাট। মূলত বৃক্ষ মানুষের বড় বন্ধু। বৃক্ষ ছাড়া মানব জীবন অচল।

বৃক্ষরোপণ, সংরক্ষণ ও লালনের যে কত অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে, তা বুঝা যায় রাসূল-এর অমিয় বাণী থেকে। এক হাদীসে তিনি বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি কোনো জমিতে কোনো গাছ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে কোনো শস্য আবাদ করে অতঃপর তা থেকে কোনো পাখি বা মানুষ কিংবা কোনো পশু কিছু খায় তবে তা তার জন্য একটি সদকা বা দানে পরিণত হয়।’

যে কোনো জনপদের স্বাভাবিক পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য মোট ভূভাগের অন্তত শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশে এর পরিমাণ মাত্র বর্তমানে ১৭ ভাগ। এদেশে যে হারে বন ও বৃক্ষ উজাড় হচ্ছে, সে হারে গাছ লাগানো হচ্ছে না। যা লাগানো হচ্ছে, তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আজ প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ভূমিক্ষয় ও পাহাড় ধস এখন এদেশের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য মানুষের কর্মফলই দায়ী।

আল্লাহ বলেছেন “জলস্থলে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তা মানুষের দু’হাতের কর্মফল।” এ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য পরিকল্পিত বনায়ন ও গাছ লাগানো প্রয়োজন। তবে যেসব গাছে সবসময় সবুজ পাতা থাকে, ফুল ফোটে, ফল ধরে, প্রজাপতি, মৌমাছি ও কীটপতঙ্গ আকৃষ্ট করে, বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ আনে, এসব গাছই প্রকৃতির ভারসাম্যের জন্য অধিক সহায়ক।

বনজ গাছের চেয়ে ফলজ গাছ এজন্য বেশি কার্যকরী। যেসব গাছ ফল দেয় তাতে সবসময় পাতা থাকে। সবসময় পাতা না থাকলে পাখিরা আসে না, বাসা বাঁধে না, বাচ্চা দেয় না। পাখিরাও বনায়নে সহযোগিতা করে। ফলের বিচি প ঠোঁটে করে দূর ও দুর্গম স্থানে নিয়ে যায়। সুদূর অতীত থেকে প্রকৃতির বনায়ন এভাবেই হয়ে এসেছে। হাদীসের ইশারাও ফলবান বৃক্ষ রোপণের দিকে। তাই এরূপ বৃক্ষ রোপণে সকলের অংশগ্রহণ করা উচিত।

এখন আর বৃক্ষ নিধন নয়, প্রয়োজন বৃক্ষরোপণ, পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং বনায়ন অভিযান। গাছ লাগালেই হবে ব না। তা বাঁচাতে হবে। ঘরের আঙ্গিনায়, নদীর কিনারায়, পাহাড়ের ঢালে, উপকূল এলাকায়, সড়কের পাশে সর্বত্র গাছ লাগানো ও বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে। উজাড় বনভূমিতে সবুজের সমারোহ সৃষ্টি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বৃক্ষরোপণ একটি ইবাদত। বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই মানুষ ১. অপরিসীম কল্যাণ পেতে পারে। রাসূল একে সদকা বা দান হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এ থেকে রোপণকারী অব্যাহত কল্যাণ ও সওয়াব পেতে থাকবে। এর আর্থিক মূল্য অনেক। নৈতিক মূল্য আরো বেশি। রাসূল অযথা গাছের একটি পাতাও ছিঁড়তে নিষেধ করেছেন। তাতে গাছ ব্যথা পায়। এতে প্রমাণিত হলো, গাছেরও প্রাণ আছে। তাই বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটা একটি প্রাণ সংহারতুল্য অপরাধ। এই নৈতিকবোধও মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে। তবেই বৃক্ষরোপণ, বৃক্ষসংরক্ষণ এবং পরিবেশ উন্নয়ন সম্ভব হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে নৈতিক উন্নয়ন প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের পূর্বশর্ত।