ই-পেপার | বুধবার , ৩রা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ঘন কুয়াশায় আলুতে মড়ক রোগ, উৎপাদনের লক্ষ্যপূরণ নিয়ে শঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় কয়েক দিন ধরেই সূর্যের দেখা নেই। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আলুখেতে দেখা দিয়েছে লেট ব্লাইট বা নাবি ধসা রোগ, কৃষকরা যাকে মড়ক বলছেন। ছত্রাকজনিত রোগটি ছড়িয়ে পড়ায় একদিকে ফলন নিয়ে যেমন শঙ্কা তৈরি হয়েছে অন্যদিকে প্রতিকূল আবহাওয়া ও দাম ভালো থাকায় অপরিণত আলু তুলে ফেলছেন কৃষক। এসব কারণে চলতি বছর আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফসলের রোগতত্ত্ববিদরা জানান, লেট ব্লাইটে আক্রান্ত হলে প্রথমে আলুর পাতা ঝলসে যায় এবং ধীরে ধীরে গাছ মরে যায়। সাধারণত তিনদিন টানা সূর্যালোক দেখা না গেলে ও ঘন কুয়াশায় আলুখেতে রোগটি দেখা দেয়। আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণেও হতে পারে। মূলত এ সময় পাতা ভেজা থাকায় মড়ক ছড়িয়ে পড়ে। চলতি মৌসুমে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

সাধারণত নভেম্বরের শুরু থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আলু রোপণ করেন কৃষক। এর মধ্যে আগাম জাতের আবাদ হয় নভেম্বরে। অনেকে অক্টোবরের মাঝামাঝিতেও আবাদ করেন। এ আলু ৬৫-৭৫ দিনে পরিণত হয়। ডিসেম্বরের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ে রোপণ করা হয় মূল মৌসুমের আলু। সাধারণত সবজিটি পরিণত হতে সময় লাগে ৯০ দিন। সে হিসেবে মূল মৌসুমের আলুর বয়স এখন ৪০-৪৫ দিনের মতো।

দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মড়কের কারণে আলু গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। হলুদ হয়ে যাচ্ছে পাতা ও কাণ্ড। ফসল বাঁচাতে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করছেন কৃষক। এতে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ।

আলু উৎপাদনে সারা দেশের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ জেলা বগুড়া। পাকড়ি, এস্টারিক্স, কারেজ, কার্ডিনাল, ডায়মন্ড, গ্র্যানোলাসহ ৩০ জাতের আলু চাষ হয় উত্তরের এ জেলায়। গত মৌসুমে প্রায় ১২ লাখ ২৪ হাজার টন আলু উৎপাদন হয়েছে। জেলাটির শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার, ধামাহার, গুজিয়া, মোকামতলা, বুড়িগঞ্জ, আটমুল ও নয়াপাড়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে দুই দফা শৈত্যপ্রবাহ, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও ঘন কুয়াশার কারণে আলুখেতে ছড়িয়ে পড়েছে মড়ক। ছত্রাকজনিত এ রোগ থেকে বাঁচতে জমিতে বালাইনাশক দিচ্ছেন কৃষক। তবে মড়ক লাগলে জমির অপরিপক্ব আলু তুলে ফেলা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না বলে জানান তারা।

জেলাটির সদর উপজেলার আশোকোলা গ্রামের আলুচাষী খোকন হোসেন জানান, কিছু কিছু স্থানে আলুর জমিতে পচন ও হলুদ ভাব দেখা দিয়েছে। দ্রুত সেরে না উঠলে আলুর ফলন খুব একটা ভালো হবে না এবার। কৃষি অফিসকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

বগুড়া আবহাওয়া অফিসের উচ্চমান পর্যবেক্ষক নুরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগামীতে শীতের তীব্রতা আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাপমাত্রা কমে গেলে শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। বৃহত্তর বগুড়া অঞ্চলে গত এক দশকের চেয়ে রাতের তাপমাত্রা বেশি কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন উপজেলায় দুপুর ১২টায় সূর্যের মুখ দেখা যায়। আবার বিকালের পর পরই সূর্য ডুবে যায়। এ কারণে জমিতে ভালো আলো না পড়ায় ফসল রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।’

কৃষি কর্মকর্তারা যদিও বলছেন, বৃষ্টিপাত না হলে আর আবহাওয়া অনুকূল থাকলে শেষ পর্যন্ত ফলন বেড়ে যেতে পারে। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান ফরিদ জানান, শীতকালীন ফসলে অতীতে রোগবালাই ছিল, এখনো আছে। এ বছর আলুখেত্রে লেট ব্লাইট রোগ দেখা দিয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখে কৃষি বিভাগ কাজ করছে। এখন পর্যন্ত বগুড়ায় রোগটি স্বাভাবিক। দু-একদিনের মধ্যে আরো স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

আলু উৎপাদনে শীর্ষে থাকা জেলাগুলোর আরেকটি জয়পুরহাট। তবে এবার মড়কের কারণে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এ অঞ্চলের কৃষক। তারা জানিয়েছেন, আক্রান্ত খেতে ছত্রাকনাশক স্প্রে করেও সুফল মিলছে না। কালাই উপজেলার পাঁচশিরা গ্রামের আলুচাষী আব্দুন নূর, বজলুর রশিদ, মুনসুর রহমানসহ একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছর পাঁচ-সাত বিঘা জমিতে আলু রোপণ করেন তারা। এবার আলুর বাড়ন্ত মুহূর্তে বৈরী আবওহাওয়ার কারণে লেট ব্লাইট রোগ ছড়িয়ে পড়ায় ফলন নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে।

স্থানীয় এসিআই সিডের আলুবীজ ডিলার ও সফল কৃষক সরদার বলেন, ‘বিভিন্ন জাতের প্রায় ৭৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। এর মধ্যে পাঁচ বিঘা ছাড়া সব জমিতেই লেট ব্লাইট রোগে গাছ মরে আলুতে পচন ধরেছে। বর্তমানে দর ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচের টাকাই উঠবে না। আলু গাছ রক্ষায় নিয়মিত ছত্রাকনাশক স্প্রে করেও রক্ষা হচ্ছে না।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ রাহেলা পারভীন বলেন, ‘ঠাণ্ডা আবহাওয়া আলু চাষের জন্য উপকারী হলেও একটানা ঘন কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহ এ ফসলের জন্য ক্ষতিকর। ঘন কুয়াশা থাকলে আলুখেত ছত্রাকে আক্রান্ত হয়।’

গত মৌসুমে দাম ভালো পাওয়ায় লাভের আশায় এবার গাইবান্ধার চাষীরাও আলু চাষে ঝোঁকেন। তবে তীব্র শীতে রোগ সংক্রমণের কারণে ফলন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে লেট ব্লাইট। জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার কেওয়াবাড়ী গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি ১৬ শতক জমিতে আলু আবাদ করেছি। গত কয়েক দিনের শীত ও ঘন কুয়াশায় রোগ দেখা দিয়েছিল, কিন্তু কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে কীটনাশক ব্যবহার করে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. খোরশেদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় মড়ক দেখা দিয়েছে। এজন্য বাড়তি পরিচর্যা দরকার। আমরা সবসময় কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। ফসলের তেমন ক্ষতির আশঙ্কা নেই। বৈরী আবহাওয়া কেটে গেলেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’

দিনাজপুরের হিলিতে কয়েক দিন ধরে বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরছে। চার-পাঁচদিন ধরে সূর্যের দেখা নেই। সেই সঙ্গে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকায় আলুখেতে ছড়িয়ে পড়ছে মড়ক। এতে উৎপাদন ব্যাহতের পাশাপাশি খরচ তোলা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন চাষীরা।

চণ্ডীপুর গ্রামের কৃষক পলাশ বসাক জানান, ১৫-২০ দিনের মধ্যে আলু তোলার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু শেষ সময়ে এসে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে আলুতে মড়ক দেখা দিয়েছে। যে গাছে ওই রোগ দেখা দিচ্ছে সেটি মরে যাচ্ছে। এখন উৎপাদন খরচ ওঠানো নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

ইসমাইলপুর গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মড়কের কারণে বহু ট্রিটমেন্ট করতেছি। ওষুধ ছিটাচ্ছি, কোনো কাজ হচ্ছে না। এত টাকাপয়সা খরচ করে ওষুধ দিচ্ছি। এখন যদি রোগ না সারে তাহলে আমি তো শেষ হয়ে যাব। আবার শুনতেছি কয়েক দিনের মধ্যে আবহাওয়া আরো খারাপ হবে।’

কুড়িগ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মড়ক। রাজারহাট উপজেলার ছিনাই এলাকার কৃষক বাবলু মিয়া জানান, তিনি দেড় একর জমিতে আলু লাগিয়েছিলেন। আগাম আলুতে কোনো সমস্যা না হলেও নমল জাতের আলুখেত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে গাছের গোড়ার পাতা কুঁকড়ে যাচ্ছে। তারপর লাল হয়ে পচন ধরছে।

নওগাঁ সদর উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের ছোট চাকলা গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি বছর নিজে খাওয়ার জন্য এক বিঘা জমিতে আলু আবাদ করতাম। কিন্তু এবার দাম বেশি দেখে লাভের আশায় চার বিঘা জমিতে আলু আবাদ করেছি। গাছগুলোও হৃষ্টপুষ্ট হইছিল। আর ২০-২২ দিন পরই আলু পরিপক্ব হয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ করে খেতে মড়ক দেখা দিয়েছে। গাছ নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে। দু-একটা করে গাছ উপড়ে দেখতেছি আলু পচে গেছে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাঁচদিনের শৈত্যপ্রবাহে ঘন কুয়াশার কারণে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির আলুখেত লেট ব্লাইট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ রোগ প্রতিরোধের জন্য শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার সময় নির্দিষ্ট মাত্রায় ছত্রাকনাশক ছিটানোর পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই আলু কৃষকের ঘরে উঠবে। আবহাওয়াও স্বাভাবিক হবে। তাই লেট ব্লাইট রোগের বর্তমান পরিস্থিতি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় প্রভাব ফেলবে না।’

এদিকে বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়াবিদরা যদিও বলছেন, টানা ঘন কুয়াশা থাকায় ফসলে রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা বেশি ছিল। বৃষ্টি হলে আকাশ পরিষ্কার হবে। সূর্যের আলো পেলে তখন রোগবালাই কমে যাবে। এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত এক সপ্তাহ উত্তরাঞ্চলের অনেক স্থানেই সূর্যের আলো দেখা যায়নি। এ কারণে রোগবালাই ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে হালকা বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। বৃষ্টি হলে আকাশে মেঘ কমে যাবে। কুয়াশাও কমে আসবে। তখন সূর্যের আলো পড়লে ফসলের জন্য উপকার হবে। তবে বৃষ্টির পর রাতের তাপমাত্রা কমে যেতে পারে।’

ঠাণ্ডা বেশি থাকলে পোকামাকড়ের আক্রমণ কম থাকে বলে জানান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ। তবে ঘন কুয়াশা, পাতা ভেজা থাকলে ও সূর্যের আলো না পড়লে লেট ব্লাইট রোগ দেখা দেয় জানিয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রির বেশি হলেও এ রোগ দেখা দিতে পারে। এ কারণে আগেই স্প্রের মাধ্যমে পচনরোধী ছত্রাকনাশক দিতে হবে। তবে অনেক কৃষক রোগের কারণে আগেই অপরিণত আলু তুলে ফেলছেন। অপরিণত আলু উত্তোলন ও রোগের কারণে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর দেশে সাড়ে চার লাখ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ১৬ লাখ টন। এর মধ্যে উচ্চফলনশীল আলু আবাদ হয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার হেক্টর জমিতে আর স্থানীয় আলু আবাদ হয়েছে ৫৬ হাজার ৫০৫ হেক্টরে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরজমিন উইংয়ের পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রোগ ছড়িয়ে পড়লে কৃষক তা কীভাবে প্রতিকার করতে পারবেন তার একটি নির্দেশনা আমরা মাঠ কর্মকর্তাদের দিয়ে দিয়েছি। তারা কৃষকদের এ বিষয়ে পরামর্শ দেবেন।’
সূত্র: বণিক বার্তা