ইকরা তৌহিদ মিম:
অভাবি সংসারের যুবক জিয়াউর রহমান চাকরি করতেন সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে। উলিপুর উপজেলার ধরনীবাড়ী ইউনিয়নের বাকারায় মধুপুরের দালালিপাড়ার ছকিয়ত আলি ও জেলেখা বেগমের সন্তান তিনি। তিন ভাই-বোনের মধ্যে জিয়া সবার বড়।
জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমাদের বসতবাড়ি পাঁচ শতক জমি ছাড়া আর কোনো জমি নেই। বাবা শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় ঠিকমতো কাজ করতে পারতেন না। এ কারণে বাবাকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করতে হয়েছে। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন।’
জিয়া বলেন, ‘অভাবের সংসার হওয়ায় পরিবারে সবসময় ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকতো। পড়াশোনার কোনো পরিবেশ ছিল না। পড়ার টেবিল ছিল না। ছোট ঘরের এক পাশে গরু-ছাগল থাকতো, আরেক পাশে বাঁশ দিয়ে টং পেতে আমাকে থাকতে হয়েছে। এভাবে পড়াশোনা করে ২০১২ সালে নতুন অনন্তপুর দাখিল মাদরাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দিয়ে ‘এ প্লাস’ পাই। কিন্তু আলিমে পড়াশোনা হবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। বই কেনার টাকা জোগাড় করতে ঢাকায় চলে যাই।’
জিয়াউর রহমান বলেন, ‘ঢাকায় এসে একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করি। কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ি ফিরে আসি, কিন্তু বই কেনা হয় না। ছোটবোনের বিয়ের জন্য সেসব টাকা শেষ হয়ে যায়। আবার মুন্সীগঞ্জের আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে যাই। কিছুদিন কাজ করে কিছু টাকা নিয়ে আসি।’
এবার কিছু পুরনো বই কিনে পড়া শুরু করেন জিয়া। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে অন্যের জমিতে কাজ করে সংসারে সহযোগিতা করতে থাকেন। ২০১৪ সালে আলিম পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ৪.৬৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। তাঁর স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবেন, কিন্তু ভর্তি প্রস্তুতির কোচিং করার টাকা ছিল না। তাই ঢাকায় গিয়ে একটি ওষুধ কম্পানিতে চাকরি নেন। সারাদিন ওষুধ কোম্পানির কাজ করে রাতে মেসে ফিরে পড়ার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না।
তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন, কিন্তু উত্তীর্ণ হননি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মিরপুর বাঙলা কলেজে সুযোগ পান।
জিয়াউর রহমান বলেন, ‘মিরপুর বাঙলা কলেজে সুযোগ পেলেও টাকার অভাবে ভর্তি হতে পারিনি। পরের বছর কোচিং করার চিন্তা করি। কিন্তু চলার মতো হাতে টাকা নেই। তাই টাকার জন্য একটি সিকিউরিটি গার্ড কোম্পানিতে গার্ডের চাকরি নিই। পাশাপাশি ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিংয়ে ভর্তি হই। চাকরি-কোচিং একসঙ্গে চলে। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস! সেবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড টাইম ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।’
এরপর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান জিয়াউর রহমান। ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। শুরু হয় নতুন এক সংগ্রাম, নতুন স্বপ্ন। কিভাবে পড়াশোনার খরচ আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। থাকা, খাওয়া ও সামান্য কিছু হাতখরচের টাকার জন্য খণ্ডকালীন কাজ করেন। প্রথম বর্ষের পরীক্ষার আগে মেসে ওঠেন। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে দুই বছর বৃত্তি পান। এ ছাড়া টিউশনি, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করেন। সেখান থেকে কিছু টাকা প্রতি মাসে বাড়িতে দিতে হতো। সারাজীবন অভাব-অনটন আর পারিবারিক অশান্তিতে জীবন কেটেছে। তাই ‘যেভাবেই হোক, ভালো চাকরি পেতে হবে’ এই বাসনা নিয়ে চাকরির জন্য পড়াশোনা করেন। প্রথম বর্ষের রেজাল্ট ভালো না হওয়ায় ডিপার্টমেন্টের পড়াশোনা তেমন গুরুত্ব দেননি। অনার্সে জিয়াউর রহমানের রেজাল্ট আসে সিজিপিএ ৩.৪১। অ্যাপিয়ার্ড দিয়ে ৪১তম বিসিএসে আবেদন করেন। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন, তাই প্রস্তুতি ভালোই ছিল। কিন্তু করোনায় সবকিছু বন্ধ হওয়ায় ইনকামও বন্ধ হয়ে যায়।
আবার আর্থিক সংকটে পড়েন। এ সময় বন্ধুদের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে চলেন। তখন টাকার জন্য টাইলস মিস্ত্রি ও রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কাজ করেন। প্রিলিমিনারির সূচি প্রকাশের পর আবার রাজশাহীতে চলে আসেন। হল না খোলায় কাছের এক বন্ধুর মেসে উঠে দুই মাস প্রস্তুতি নেন। পরে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন। লিখিত পরীক্ষার জন্য কোচিং করার ইচ্ছা থাকলেও টাকার কারণে করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটি বিসিএস কোচিংয়ে সামান্য টাকায় শুধু মডেল টেস্ট বা নমুনা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ভর্তি হন। প্রস্তুতি ভালোই ছিল, কিন্তু অসুস্থতা এবং মাস্টার্স পরীক্ষা থাকায় লিখিত পরীক্ষা মোটামুটি হলেও যেভাবে চেয়েছিলেন, ততোটা ভালো হয়নি। অবশেষে লিখিত পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। তারপর ভাইভা প্রস্তুতির জন্য বুঝে উঠতে পারছিলেন না কোন বই পড়বেন, কিভাবে প্রস্তুতি নেবেন। তারপর সিনিয়রদের পরামর্শে ‘ভাইভা বোর্ডের মুখোমুখি’ বইটি সংগ্রহ করেন। শুধু এই একটি বই পড়েই তিনি ভাইভা দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়। বিসিএসের রেজাল্ট যেদিন দেয় সেদিন শিক্ষা ক্যাডারে নিজের রোলটি দেখে জিয়াউরের চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন তিনি।সূত্র:কালেরকন্ঠ